আমার মনে আছে, এই দিন আওয়ামী লীগ ঢাকার পল্টন ময়দানে এক সভা করছিল। সোহরাওয়ার্দী সাহেব বক্তৃতা করছিলেন। বহু জনসমাগম হয়েছিল। শহীদ সাহেব যখন বক্তৃতা করছিলেন, তখন কে একজন এসে খবর দিল, এই মাত্র রেডিওর খবরে বলেছে নাজিমুদ্দীন সাহেবকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। শহীদ সাহেব জনসাধারণকে বললেন, “আজ পাকিস্তানের একটা বিরাট খবর আছে। সভা শেষে যখন শহীদ সাহেবকে নিয়ে ফিরছিলাম, তিনি বললেন, “নাজিমুদ্দীন সাহেবকে বরখাস্ত করেছে, তবে এতে খুশি হবার কিছুই নাই।” আমি শহীদ সাহেবকে বললাম, “এটা খাজা সাহেব আর তাঁর দলবলের প্রাপ্য।” শহীদ সাহেব বললেন, “যা, শাসনতন্ত্র না দিয়ে এবং সাধারণ নির্বাচন না করে এরা পাকিস্তানকে ষড়ন্ত্রের রাজনীতিতে জড়িয়ে ফেলেছে। আরও অনেক বিষয়ে আমরা আলোচনা করেছিলাম। যাহোক, অগণতান্ত্রিকভাবে খাজা সাহেবকে ডিসমিস করার প্রতিবাদ মুসলিম লীগ নেতারা করলেন না। এক এক করে তাদের নেতাকে ছেড়ে দিয়ে ক্ষমতার লোভে মোহাম্মদ আলী সাহেবকে নেতা মেনে নিলেন। এমন কি মুসলিম লীগের সভাপতির পদও খাজা সাহেবকে ত্যাগ করতে হল। মুসলিম লীগ নেতারা মোহাম্মদ আলী বগুড়াকে নিখিল পাকিস্তান মুসলিম লীগের সভাপতি করে নিলেন, একজনও প্রতিবাদ করলেন না। আমার মনে আছে, এমন অগণতান্ত্রিকভাবে নাজিমুদ্দীন সাহেবকে বরখাস্ত করার প্রতিবাদ একমাত্র পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগই করেছিল।
পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী জনাব নূরুল আমিন খাজা সাহেবের বিশ্বস্ত ভক্ত ছিলেন। তিনি ও অন্যান্য প্রদেশের মুসলিম লীগ প্রধানমন্ত্রীরাও মোহম্মদ আলী সাহেবকে আনুগত্য জানালেন এবং একমাত্র নেতা হিসাবে গ্রহণ করে নিলেন। এই ঘটনার পরে আর কোনো শিক্ষিত মানুষ বা বুদ্ধিজীবীদের মুসলিম লীগের উপর আস্থা থাকার কারণ ছিল না। এটা যে একটা সুবিধাবাদী ও সুযোগ সন্ধানীদের দল তাই প্রমাণ হয়ে গেল। গোলাম মোহাম্মদ বড়লাট হয়ে এ সাহস কোথা থেকে পেয়েছিলেন? বড় বড় সরকারি কর্মচারী এবং এক অদৃশ্য শক্তি তাকে অভয় দিয়েছিল এবং দরকার হলে তার পেছনে দাঁড়াবে সে প্রতিশ্রুতিও তিনি পেয়েছিলেন। মুসলিম লীগ নেতা ও কর্মীদের চরিত্র সম্বন্ধে তার ধারণা ছিল। খাজা সাহেবের সমর্থকরা একে একে মোহম্মদ আলী সাহেবের মন্ত্রিত্বে যোগদান করলেন। খাজা। সাহেব নিজেও এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সাহস পেলেন না। ১৯৪৬ সালে যেমন চুপটি করে ঘরে বসে পড়েছিলেন, এবারও তিনি বিশ্রাম গ্রহণ করলেন—যদি কোনোদিন সুযোগ আসে তখন আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবেন, এই ভরসায়।
মোহাম্মদ আলীর (বগুড়া) মধ্যে কোনো রাজনৈতিক চেতনা ছিল না। তার মধ্যে কোনো গভীরতাও ছিল না। শুধু আমেরিকা থেকে তিনি আমেরিকানদের মত কিছু হাবভাব ও হাঁটাচলা আর কাপড় পরা শিখে এসেছিলেন। গোলাম মোহাম্মদ যা বলেন, তাতেই তিনি রাজি। আর আমেরিকানরা যে বুদ্ধি দেয় সেইটাই তিনি গ্রহণ করে চলতে লাগলেন। আমেরিকান শাসকগোষ্ঠীরা যেমন সকল কিছুর মধ্যে কমিউনিস্ট দেখতেন, তিনিও তাই দেখতে শুরু করলেন। প্রথমে তিনি শহীদ সাহেবকে তাঁর রাজনৈতিক পিতা’ বলে সম্বােধন করলেন, পরে তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করতে শুরু করলেন।
৭৮.
মওলানা ভাসানী, আমি ও আমার সহকর্মীরা সময় নষ্ট না করে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠান গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করলাম। পূর্ব বাংলার জেলায়, মহকুমায়, থানায় ও গ্রামে গ্রামে ঘুরে এক নিঃস্বার্থ কর্মীবাহিনী সৃষ্টি করতে সক্ষম হলাম। ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ছাত্ররা মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে মন প্রাণ দিয়ে রুখে দাঁড়াল। দেশের মধ্যে স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি চরম আকার ধারণ করেছিল। শাসনযন্ত্র শিথিল হয়ে গিয়েছিল। সরকারি কর্মচারীরা যা ইচ্ছা তাই করতে পারত। খাদ্য সংকট চরম আকার ধারণ করে। বেকার সমস্যা ভীষণভাবে দেখা দিয়েছে। শাসকদের কোন প্ল্যান প্রোগাম নাই। কোনোমতে চললেই তারা খুশি। পূর্ব বাংলার মন্ত্রীরা কোথাও সভা করতে গেলে জনগণ তাদের বক্তৃতা শুনতেও চাইত না। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির কথা কেউই ভুলে নাই। আমরা তাড়াতাড়ি শাসনতন্ত্র করতে জনমত সৃষ্টি করতে লাগলাম। পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি মেনে নেওয়া ছাড়া এবং বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা না মেনে নিলে আমরা কোনো শাসনতন্ত্র মানব না। এসময় ফজলুর রহমান সাহেব আরবি হরফে বাংলা লেখা পদ্ধতি চালু করতে চেষ্টা করছিলেন। আমরা এর বিরুদ্ধেও জনমত সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলাম। কোনো কোনো মুসলিম লীগ নেতা এককেন্দ্রিক সরকার গঠনের জন্য তলে তলে প্রপাগান্ডা করছিলেন। আওয়ামী লীগ ফেডারেল শাসনতন্ত্র ও আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবির ভিত্তিতে প্রচার শুরু করে জনগণকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছিল।
বিনা বিচারে কাউকে বন্দি করে রাখা অন্যায়। ফলে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠেছিল। প্রগতিশীল যুবক কর্মীরাও আওয়ামী লীগে যোগদান করতে আরম্ভ করছিল। ১৯৫৩ সালের মাঝামাঝি পূর্ব বাংলায় সাধারণ নির্বাচন হবে। ঘোষণা করা হল। আওয়ামী লীগ ও মুসলিম লীগের মধ্যেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে এ সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ রইল না। গণতান্ত্রিক দল’ নামে একটা রাজনৈতিক দল করা হয়েছিল, তা কাগজপত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। জনাব এ, কে, ফজলুল হক সাহেব তখন পর্যন্ত এডভোকেট জেনারেল ছিলেন ঢাকা হাইকোর্টের। পাকিস্তান হওয়ার পরে আর তিনি কোনো রাজনীতি করেন নাই। ১৯৫৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি এডভোকেট জেনারেলের পদ থেকে পদত্যাগ করে মুসলিম লীগে যোগদান করেন। মুসলিম লীগের মধ্যে তখন কোন্দল শুরু হয়েছিল ভীষণভাবে। মোহন মিয়া সাহেব নূরুল আমিন সাহেবের বিরুদ্ধে গ্রুপ সৃষ্টি করেন এবং হক সাহেবকে মুসলিম লীগের সভাপতি করতে চেষ্টা করে পরাজিত হন। কার্জন হলে দুই গ্রুপের মধ্যে বেদম মারপিটও হয়। নূরুল আমিন সাহেবের দলই জয়লাভ করে, ফলে মোহন মিয়া ও তাঁর দলবল লীগ থেকে বিতাড়িত হলেন।