আওয়ামী লীগ যখন হিসাব-নিকাশ বের করে প্রমাণ করল যে, পূর্ব বাংলাকে কি করে শোষণ করা হচ্ছে তখন তারা মরিয়া হয়ে উঠল এবং আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগ নেতাদের উপর চরম অত্যাচার করতে আরম্ভ করল। এদিকে জনগণ মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠান ও সরকারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ক্ষেপে উঠছিল। পূর্ব বাংলায় তখন মুসলিম লীগের নাভিশ্বাস শুরু হয়েছে।
খাজা সাহেবের আমলে পালাবে এক ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়। তাতে হাজার হাজার লোক মারা যায়। লাহোরে মার্শাল ল জারি করা হয়। আহমদিয়া বা কাদিয়ানি বিরোধী আন্দোলন থেকে এই দাঙ্গা শুরু হয়। কয়েকজন বিখ্যাত আলেম এতে উসকানি দিয়েছিলেন। কাদিয়ানিরা মুসলমান না’—এটাই হল এই সকল আলেমদের প্রচার। আমার এ সম্বন্ধে বিশেষ কোনো ধারণা নাই। তবে একমত না হওয়ার জন্য যে অন্যকে হত্যা করা হবে, এটা যে ইসলাম পছন্দ করে না এবং একে অন্যায় মনে করা হয়এটুকু ধারণা আমার আছে। কাদিয়ানিরা তো আল্লাহ ও রসুলকে মানে। তাই তাদের তো কথাই নাই, এমনকি বিধর্মীর উপরও অন্যায়ভাবে অত্যাচার করা ইসলামে কড়াভাবে নিষেধ করা আছে। লাহোরে ও অন্যান্য জায়গায় জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে স্বামী, স্ত্রী, ছেলেমেয়েকে একসাথে ফেলে দিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। যারা এই সমস্ত জঘন্য দাঙ্গার উসকানি দিয়েছিল তারা আজও পাকিস্তানের রাজনীতিতে সশরীরে অধিষ্ঠিত আছে।
পাকিস্তান হবে একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এখানে প্রত্যেক ধর্মাবলম্বী বা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষের সমান নাগরিক অধিকার থাকবে। দুঃখের বিষয়, পাকিস্তান আন্দোলনের যারা বিরুদ্ধাচরণ করেছিল, এখন পাকিস্তানকে ইসলামিক রাষ্ট্র করার ধুয়া তুলে রাজনীতিকে তারাই বিষাক্ত করে তুলেছে। মুসলিম লীগ নেতারাও কোনো রকম অর্থনৈতিক ও সমাজনৈতিক প্রোগ্রাম না দিয়ে একসঙ্গে যে শ্লোগান দিয়ে ব্যস্ত রইল, তা হল ইসলাম’। পাকিস্তানের শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি মানুষ যে আশা ও ভরসা নিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলন, তথা পাকিস্তান আন্দোলনে শরিক হয়ে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে তাদের অর্থনৈতিক মুক্তির দিকে কোন নজর দেওয়াই তারা দরকার মনে করল না। জমিদার ও জায়গিরদাররা যাতে শোষণ করতে পারে সে ব্যাপারেই সাহায্য দিতে লাগল। কারণ, এই শোষক লোকেরাই এখন মুসলিম লীগের নেতা এবং এরাই সরকার চালায়।
অন্যদিকে পূর্ব বাংলার বৈদেশিক মুদ্রা থেকে প্ল্যান প্রোগ্রাম করেই পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্প কারখানা গড়ে উঠতে সাহায্য করতে লাগল। ফলে একদল শিল্পপতি গড়ে তুলতে শুরু করল, যারা লাগাম ছাড়া অবস্থায় যত ইচ্ছা মুনাফা আদায় করতে লাগল জনসাধারণের কাছ থেকে এবং রাতারাতি কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেল। করাচি বসে ইমপোর্ট ও এক্সপোর্ট ব্যবসার নাম করে লাইসেন্স বিক্রি করে বিপুল অর্থ উপার্জন করে আস্তে আস্তে অনেকে শিল্পপতি হয়ে পড়ছেন। এটাও মুসলিম লীগ সরকারের কীর্তি এবং খাজা সাহেবের দুর্বল নেতৃত্বও এর জন্য কিছুটা দায়ী। কারণ তিনি কোনোদিন বোধহয় সরকারি কর্মচারীদের অযৌক্তিক প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করতে পারেন নাই। এদিকে চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর মত ঘুঘু সরকারি কর্মচারীকে অর্থমন্ত্রী করে তিনি তাঁর উপর নির্ভর করতে শুরু করেছিলেন শুনেছি; ঠিক কি না বলতে পারি না, তবে কিছুটা সত্য হলেও হতে পারে। মরহুম ফজলুর রহমান সাহেবও তখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছিলেন। তিনি চৌধুরী মোহাম্মদ আলীকে বাধা দিতে চেষ্টা করেছিলেন। খাজা সাহেবের মন্ত্রীদের মধ্যে দুইটা দল হয়েছিল। ফজলুর রহমান সাহেব একটা দলের নেতৃত্ব করতেন, যাকে বাঙালি দল’ বলা হত। আরেকটা দল চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে ছিল যাকে পাঞ্জাবি দল’ বলা হত। বাঙালি তথাকথিত নেতারা কেন্দ্রীয় রাজধানী, মিলিটারি হেডকোয়ার্টারগুলি, সমস্ত বড় বড় সরকারি পদ, ব্যবসা-বাণিজ্য পাঞ্জাবি ভাইদের হাতে দিয়েও গোলাম মোহাম্মদ ও চৌধুরী মোহাম্মদ আলীকে খুশি করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। গণপরিষদে বাঙালিরা ছয়টা সিট পশ্চিম পাকিস্তানের ভাইদের দিয়েও সংখ্যাগুরু ছিলেন। তারা ইচ্ছা করলে পূর্ব বাংলার জনগণের স্বার্থ রক্ষা করতে পারতেন। তাঁরা তা না করে তাঁদের গদি রক্ষা করার জন্য এক এক করে সকল কিছু তাদের পায়ে সমর্পণ করেও গদি রাখতে পারলেন না। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা বুঝতে পেরেছেন, এদের কাছ থেকে যতটুকু নেওয়ার নেওয়া হয়েছে। এখন নতুন লোকদের নেওয়া প্রয়োজন, পুরানরা আর দিতে চাইবে না। কারণ, এরা এদের চিনতে পেরেছে বোধহয়। পূর্ব বাংলার নেতাদের দিয়ে এমন সকল কাজ করিয়েছে যে, এদের আর পূর্ব বাংলার জনগণ বিশ্বাস করবে না। ধাক্কা দিলেই এরা পড়ে যাবে। যেমন খাজা সাহেবকে দিয়ে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে বক্তৃতা করিয়ে তার উপর বাঙালিদের যতটুকু আস্থা ছিল তাও খতম করতে সক্ষম হয়েছিল। এবার তাই নতুন চাল চালতে শুরু করল। ঘাগু ব্রিটিশ আমলের সরকারি আমলাদের কূটবুদ্ধির কাছে এরা টিকবে কেমন করে? জনগণের আস্থা হারিয়ে এরা সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল আমলাতন্ত্রের উপরে, যারা সকলেই প্রায় পশ্চিম পাকিস্তান তথা পাত্তাবের অধিবাসী।
১৯৫৩ সালের এপ্রিল মাসে গভর্নর জেনারেল জনাব গোলাম মোহাম্মদ ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের সভাপতি, গণপরিষদ ও পার্লামেন্টের সংখ্যাগুরু দলের নেতা প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনকে বরখাস্ত করে আমেরিকায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ আলী বগুড়াকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করলেন, যদিও মোহাম্মদ আলী গণপরিষদের সদস্য ছিলেন না। এমনকি মুসলিম লীগেরও সভ্য ছিলেন না। ১৯৪৮ সাল থেকে তিনি পাকিস্তানের বাইরেই ছিলেন, দেশের মানুষের কোন খবরই রাখতেন না।