আমার বিরোধী গ্রুপ অনেক চেষ্টা করেও কোনো প্রার্থী দাঁড় করাতে পারছিলেন না। কেউই সাহস পাচ্ছিল না, আমার সাথে প্রতিদ্বন্দিতা করতে। কারণ তারা জানেন, কাউন্সিলাররা আমাকেই ভোট দিবে। ভদ্রলোকেরা তাই নতুন পন্থা অবলম্বন করলেন। তারা আবুল হাশিম সাহেবের কাছে ধরনা দিলেন এবং তাঁকে আওয়ামী লীগে যোগদান করতে ও সাধারণ সম্পাদক হতে অনুরোধ করলেন। হাশিম সাহেব রাজি হলেন এবং বললেন, তার কোনো আপত্তি নাই, তবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হতে হবে। তিনি মওলানা ভাসানী সাহেবকে খাবার দাওয়াত করলেন। তাকে যে কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা এ ব্যাপারে অনুরোধ করেছেন তাও বললেন এবং মওলানা সাহেবের মতামত জানতে চাইলেন। মওলানা সাহেব তাকে বললেন, “সাধারণ সম্পাদক বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় করা যাবে কি না সন্দেহ, কারণ মুজিবের আপনার সম্বন্ধে খুব খারাপ ধারণা। তবে যদি সভাপতি হতে চান, আমি ছেড়ে দিতে রাজি আছি।” মওলানা সাহেব একথা আমাকে বলেছিলেন।
কাউন্সিলের প্রথম অধিবেশন হওয়ার পরে মওলানা ভাসানী ঘোষণা করলেন, আমাদের চারজনের নামসর্বজনাব আতাউর রহমান খান, আবদুস সালাম খান, আবুল মনসুর আহমদ ও আমি। এই চারজন আলাদা বসে সর্বসম্মতিক্রমে একটা লিস্ট করে আনবে কর্মকর্তাদের নামের। কাউন্সিল সভার একদিন পূর্বে আমার বিরোধী গ্রুপ আতাউর রহমান সাহেবকে অনুরোধ করলেন সাধারণ সম্পাদক হতে। আতাউর রহমান সাহেব একটু নিমরাজি হয়ে পড়লেন এবং আমার সাথে পরামর্শ করবেন বলে দিলেন। আতাউর রহমান সাহেব আমাকে ডেকে বললেন, তাঁদের অনুরোধের কথা। আমি তাঁকে বলে দিলাম এখন আর সময় নাই, পূর্বে হলে রাজি হতাম। তাদের কাউকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে বলেন। আতাউর রহমান সাহেব তাদের জানিয়ে দিলেন। তাঁরা মওলানা সাহেবের কাছে অনুরোধ করলে, তিনি চারজনের উপর কমিটির নাম প্রস্তাব করার ভার দেয়ার কথা বললেন। তবে তা সর্বসম্মতিক্রমে হতে হবে। আলোচনা সভা বেশি সময় চলল না, কারণ অন্য কোনো নাম তারা প্রস্তাব করতে পারলেন না। আমি কাউন্সিল সভায় উপস্থিত হয়ে ভাসানী সাহেবকে জানিয়ে দিলাম, নির্বাচন হবে। একমত হতে পারা গেল না। আতাউর রহমান সাহেব আমাকে সমর্থন করলেন। আমরা ম্যানিফেস্টো ও গঠনতন্ত্র নিয়ে সমস্ত রাত আলোচনা করলাম সাবজেক্ট কমিটিতে। কাউন্সিল সভায় ম্যানিফেস্টো ও গঠনতন্ত্র গ্রহণ করা হল এবং নির্বাচনও সর্বসম্মতিক্রমে হয়ে গেল। মওলানা ভাসানী সভাপতি, আতাউর রহমান সাহেব সহ-সভাপতি, আমি সাধারণ সম্পাদক (ম্যানিফেস্টো আমার কাছে এখন নাই, পরে তুলে দিব)।২৫ এখন আওয়ামী লীগ একটা সত্যিকারের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে জনগণের সামনে দাঁড়াল। ম্যানিফেস্টো বা ঘোষণাপত্র না থাকলে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান চলতে পারে না।
এর পূর্বে আমরা লাহোরে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কনফারেন্সে যোগদান করি। সেখানে জমিদারি প্রথা বিলোপ এবং অন্যান্য প্রোগ্রাম নিয়ে নবাব মামদোতের সাথে একমত হতে না পারায় নবাব সাহেব আওয়ামী লীগ ত্যাগ করলেন।
পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে বিরাট প্রভেদ রয়েছে। সেখানে রাজনীতি করে সময় নষ্ট করার জন্য জমিদার, জায়গিরদার ও বড় বড় ব্যবসায়ীরা। আর পূর্ব পাকিস্তানে রাজনীতি করে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়। পশ্চিম পাকিস্তানে শক্তিশালী মধ্যবিত্ত থাকার জন্য জনগণ রাজনীতি সম্বন্ধে বা দেশ সম্বন্ধে কোনো চিন্তাও করে না। জমিদার বা জায়গিরদার অথবা তাদের পীর সাহেবরা যা বলেন, সাধারণ মানুষ তাই বিশ্বাস করে। বহুকাল থেকে বাংলাদেশে কৃষক আন্দোলন হওয়াতে জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের চেয়ে অনেকটা বেশি। এছাড়াও স্বাধীনতা আন্দোলনেও বাঙালিরা সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছে। বাংলাদেশে দীর্ঘকাল যাবৎ গ্রাম পঞ্চায়েত প্রথা, তারপর ইউনিয়ন বোর্ড, লোকাল বোর্ড ও ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড থাকাতে জনগণের মধ্যেও রাজনৈতিক শিক্ষা অনেক পরিমাণে বেড়ে গিয়েছিল। শিক্ষিতের সংখ্যা বেশি না থাকলেও বাঙালিরা অজ্ঞ বা অসচেতন ছিল না। ভালমন্দ বিচার করার ক্ষমতা তাদের ছিল এবং এর প্রমাণও করেছিল ১৯৪৬ সালে পাকিস্তান দাবির উপরে সাধারণ নির্বাচনের সময়।
আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠানকে জনগণ ও শিক্ষিত সমাজ সমর্থন দিল। মুসলিম লীগের ভিতর তখন ষড়যন্ত্রের রাজনীতি চরম আকার ধারণ করেছিল। ব্রিটিশ আমলের আমলাদের রাজনীতিতে স্থান দিয়ে তারা ষড়যন্ত্রের জালে আটকে পড়েছিল। তাই প্রতিষ্ঠানের ভিতর আত্মকলহ দেখা দিল প্রবলভাবে। ছোট ছোট উপদলে ভাগ হয়ে পড়েছিল দলটি। নীতির কোন বালাই ছিল না, একমাত্র আদর্শ ছিল ক্ষমতা আঁকড়িয়ে থাকা। জেলায় ও মহকুমার পুরানা নেতাদের কোনো সংগ্রামী ঐতিহ্য যেমন ছিল না, তেমনি দুনিয়া যে এগিয়ে চলেছে সেদিকে খেয়াল ছিল না কারও। শুধু ক্ষমতায় থাকা যায় কি করে সেই একই চিন্তা।
৭৭.
এদিকে পূর্ব বাংলার সম্পদকে কেড়ে নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানকে কত তাড়াতাড়ি গড়া যায়, একদল পশ্চিমা.তথাকথিত কেন্দ্রীয় নেতা ও বড় বড় সরকারি কর্মচারী গোপনে সে কাজ করে চলেছিল। তাদের একটা ধারণা ছিল, পূর্ব বাংলা শেষ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে থাকবে না। তাই যত তাড়াতাড়ি পারা যায় পশ্চিম পাকিস্তানকে গড়ে তুলতে হবে।