আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠানকে গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করলাম। সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে খবর দিলাম, পূর্ব বাংলায় আসবার জন্য। তিনি আমাকে পূর্বেই কথা দিয়েছিলেন এক মাস সমস্ত প্রদেশ ঘুরবেন এবং জনসভায় বক্তৃতা করবেন। আমি প্রোগ্রাম করে তাঁকে জানালাম। সমস্ত জেলা হেডকোয়ার্টারে একটা করে সভা হবে এবং বড় বড় কতগুলি মহকুমায়ও সভার বন্দোবস্ত করা হল। তিনি ঢাকায় আসলেন, ঢাকায় জনসভায় বক্তৃতা করলেন। পাকিস্তান হওয়ার পরে বিরোধী দলের এত বড় সভা আর হয় নাই। তিনি পরিষ্কার ভাষায় রাষ্ট্রভাষা বাংলা, বন্দি মুক্তি, স্বায়ত্তশাসনের সমর্থনে বক্তৃতা করলেন। সিলেট থেকে শুরু করে দিনাজপুর এবং বগুড়া থেকে বরিশাল প্রত্যেকটা জেলায়ই আওয়ামী লীগ কর্মীরা সভার আয়োজন করেছিল। একমাত্র রাজশাহীতে জনসভা হয় নাই, তবে নাটোরে হয়েছিল। রাজশাহীতে তখনও জেলা কমিটি করতে আমি পারি নাই। রাজশাহীর অনেক নেতা নাটোরে শহীদ সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করলেন এবং তাঁকে রাজশাহী নিয়ে গেলেন, সেখানে বসে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠান গড়া হল। এই সময় প্রায় প্রত্যেকটা মহকুমায় ও জেলায় আওয়ামী লীগ সংগঠন গড়ে উঠেছে। শহীদ সাহেবের সভার পরে সমস্ত দেশে এক গণজাগরণ পড়ে গেল। জনসাধারণ মুসলিম লীগ ছেড়ে আওয়ামী লীগ দলে যোগদান করতে শুরু করেছিল। শহীদ সাহেবের নেতৃত্বের প্রতি জনগণের ও শিক্ষিত সমাজের আস্থা ছিল। জনগণ বিশ্বাস করত শহীদ সাহেব একমাত্র নেতা যিনি দেশের বিকল্প নেতৃত্ব দিতে পারবেন এবং তাঁকে প্রধানমন্ত্রী করতে পারলে দেশের ও জনগণের উন্নতি হবে। দেশের মধ্যে দুর্নীতি, অত্যাচার ও জুলুম চলছে। কোনো সুষ্ঠু উন্নতিমূলক কাজে সরকার হাত না দিয়ে ষড়যন্ত্রমূলক রাজনীতি শুরু করেছে। আমলাতন্ত্র ও ষড়যন্ত্রমূলক রাজনীতি শুরু করেছে। খাজা সাহেবের দুর্বল শাসনব্যবস্থার জন্য তাদের মধ্যে উচ্চাকাক্ষা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, গোলাম মোহাম্মদ, নবাব শুরমানির মত পুরানা সরকারি কর্মচারীরা রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে শুরু করেছে। পাঞ্জাবি আমলাতন্ত্রকে খুশি করার জন্য চৌধুরী মোহাম্মদ আলীকে অর্থমন্ত্রী করে খাজা সাহেব নিজেই ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। জনগণের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে এবং তারা শহীদ সাহেবের নেতৃত্বের উপর আস্থা প্রকাশ করতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক দল ছাড়া গণতন্ত্র সফল হতে পারে না। এই সময় মুসলিম লীগ দলের মোকাবেলায় একমাত্র আওয়ামী লীগই বিরোধী দল হিসাবে গড়ে উঠতে লাগল। পশ্চিম পাকিস্তানেও একদল নিঃস্বার্থ নেতা ও কর্মী আওয়ামী লীগ গঠন করতে এগিয়ে এলেন পীর মানকী শরীফের নেতৃত্বে।
শহীদ সাহেব পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব বাংলায় ঘুরে ঘুরে প্রতিষ্ঠান গড়তে সাহায্য করতে লাগলেন। প্রত্যেকটা জনসভার পরেই আমি জেলা ও মহকুমার নেতাদের ও কর্মীদের নিয়ে আলোচনা সভা করে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান গঠনে সাহায্য করতে লাগলাম। শহীদ সাহেবের পুরানা ভক্তরা প্রায়ই আওয়ামী লীগে যোগদান করতে লাগল; বিশেষ করে যুবক শ্রেণীর কর্মীরা এগিয়ে এল মুসলিম লীগ সরকারের অত্যাচারের মোকাবেলা করার জন্য। শত শত কর্মী জেলের মধ্যে দিনযাপন করছে নিরাপত্তা আইনে। প্রথমে জেলায় জেলায় চেষ্টা করেছে আমাদের সভায় গোলমাল সৃষ্টি করার জন্য, পরে আর পারে নাই। জনমত আওয়ামী লীগ ও শহীদ সাহেবের পক্ষে ছিল। এই সময় শহীদ সাহেব মওলানা ভাসানী ও অন্য রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির জন্য প্রবল জনমত সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। মওলানা ভাসানীও এই সময় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন সারা পূর্ব পাকিস্তানে।
১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ গঠন হলেও আজ পর্যন্ত কোন কাউন্সিল সভা হতে পারেও নাই, কারণ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সকলকেই প্রায় কারাগারে দিন অতিবাহিত করতে হয়েছে। আমি সমস্ত জেলা ও মহকুমা আওয়ামী লীগকে নির্দেশ দিলাম তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন শেষ করতে হবে। তারপর পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কাউন্সিল সংগঠনের কর্মকর্তা নির্বাচন করবে এবং গঠনতন্ত্র ও ম্যানিফেস্টো গ্রহণ করবে। আমি দিনরাত সমানভাবে পরিশ্রম শুরু করলাম। শহীদ সাহেব যে সমস্ত মহকুমায় যেতে পারেন নাই আমি সেই সকল মহকুমায় সভা করে পার্টি গড়তে সাহায্য করলাম। জনগণ ও কর্মীদের থেকে সাড়া যে পেলাম তা প্রথমে কল্পনা করতে পারি নাই। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগও আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠান গড়বার কাজে সাহায্য করছিল এই জন্য যে, শক্তিশালী বিরোধী দল ছাড়া সরকারের জুলুমকে মোকাবেলা করা কষ্টকর। আওয়ামী লীগ গড়ে উঠবার পূর্ব পর্যন্ত একমাত্র ছাত্রলীগই সরকারের অত্যাচার, অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করত এবং জনগণ ও ছাত্রদের দাবি দাওয়া তুলে ধরত। ছাত্র প্রতিষ্ঠান হিসাবে তাদের নেতা ও কর্মীদের অনেক অসুবিধা ভোগ করতে হয়েছে। মুসলিম লীগ সরকার ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠানকে খতম করার জন্য চেষ্টার ক্রটি করে নাই। গণতান্ত্রিক যুবলীগও অলি আহাদের নেতৃত্বে জনমত সৃষ্টি করতে সাহায্য করেছিল।
৭৬.
১৯৫৩ সালের প্রথম দিক থেকে রাজনৈতিক ও ছাত্রকর্মীরা মুক্তি পেতে শুরু করল। শামসুল হক সাহেবও মুক্তি পেলেন, তখন তিনি অসুস্থ। তার যে কিছুটা মস্তিষ্ক বিকৃতি হয়েছে কারাগারের বন্দি থেকে, তা বুঝতে কারও বাকি রইল না। তিনি কোনো গোলমাল করতেন না, তবে কিছু সময় কথা বললেই বোঝা যেত যে, এক কথা বলতে অন্য কথা বলতে শুরু করেন। আমরা খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লাম। একজন নিঃস্বার্থ দেশকর্মী, ত্যাগী নেতা আজ দেশের কাজ করতে যেয়ে কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে থেকে পাগল হয়ে বের হলেন। এ দুঃখের কথা কোথায় বলা যাবে? পাকিস্তান আন্দোলনে তার অবদান যারা এখন ক্ষমতায় আছেন, তাঁদের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। বাংলাদেশে যে কয়েকজন কর্মী সর্বস্ব দিয়ে পাকিস্তান আন্দোলন করেছে তাদের মধ্যে শামসুল হক সাহেবকে সর্বশ্রেষ্ঠ কর্মী বললে বোধহয় অন্যায় হবে না। ১৯৪৩ সাল থেকে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠানকে জমিদার, নবাবদের দালানের কোঠা থেকে বের করে জনগণের পর্ণকুটিরে যারা নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে শামসুল হক সাহেব ছিলেন অন্যতম। একেই বলে কপাল, কারণ সেই পাকিস্তানের জেলেই শামসুল হক সাহেবকে পাগল হতে হল।