১৯৪১ সালে আমি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেব। পরীক্ষায় পাস আমি নিশ্চয়ই করব, সন্দেহ ছিল না। রসরঞ্জন বাবু ইংরেজির শিক্ষক, আমাকে ইংরেজি পড়াতেন। আর মনোরঞ্জন বাবু অঙ্কের শিক্ষক, আমাকে অঙ্ক করাতেন। অঙ্ককে আমার ভয় ছিল। কারণ ভুল করে ফেলতাম। অঙ্কের জন্যই বোধহয় প্রথম বিভাগ পাব না। পরীক্ষার একদিন পূর্বে আমার ভীষণ জ্বর হল এবং মামস হয়ে গলা ফুলে গেল। একশ’ চার ডিগ্রি জ্বর উঠেছে। আব্বা রাতভর আমার কাছে বসে রইলেন। গোপালগঞ্জ টাউনের সকল ডাক্তারই আনালেন। জুর পড়ছে না। আব্বা আমাকে পরীক্ষা দিতে নিষেধ করলেন। আমি বললাম, যা পারি শুয়ে শুয়ে দেব। আমার জন্য বিছানা দিতে বলেন। প্রথম দিনে বাংলা পরীক্ষা। সকালের পরীক্ষায় মাথাই তুলতে পারলাম না, তবুও কিছু কিছু লিখলাম। বিকালে জ্বর কম হল। অন্য পরীক্ষা ভালই হল। কিন্তু দেখা গেল বাংলায় আমি কম মার্কস পেয়েছি। অন্যান্য বিষয়ে দ্বিতীয় বিভাগের মার্কস পেয়েছি। মন ভেঙে গেল।
তখন রাজনীতি শুরু করেছি ভীষণভাবে। সভা করি, বক্তৃতা করি। বেলার দিকে আর নজর নাই। শুধু মুসলিম লীগ, আর ছাত্রলীগ। পাকিস্তান আনতেই হবে, নতুবা মুসলমানদের বাঁচার উপায় নাই। খবরের কাগজ ‘আজাদ’, যা লেখে তাই সত্য বলে মনে হয়।
পরীক্ষা দিয়ে কলকাতায় যাই। সভা-সমাবেশে যোগদান করি। মাদারীপুর যেয়ে মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করি। আবার পড়তে শুরু করলাম। পাস তো আমার করতে হবে। শহীদ সাহেবের কাছে এখন প্রায়ই যাই। তিনিও আমাকে স্নেহ করেন। মুসলিম লীগ বললেই গোপালগঞ্জে আমাকে বোঝাত। যুদ্ধের সময় দেশের অবস্থা ভয়াবহ। এই সময় ফজলুল হক সাহেবের সাথে জিন্নাহ সাহেবের মনোমালিন্য হয়। হক সাহেব জিন্নাহ সাহেবের হুকুম মানতে রাজি না হওয়ায় তিনি মুসলিম লীগ ত্যাগ করে নয়া মন্ত্রিসভা গঠন করলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির সাথে। মুসলিম লীগ ও ছাত্রকর্মীরা তাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করল। আমিও ঝাঁপিয়ে পড়লাম। এই বৎসর আমি দ্বিতীয় বিভাগে পাস করে কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হয়ে বেকার হোস্টেলে থাকতাম। নাটোর ও বালুরঘাটে হক সাহেবের দলের সাথে মুসলিম লীগের মনোনীত প্রার্থীদের দুইটা উপনির্বাচন হয়। আমিও দলবল নিয়ে সেখানে হাজির হলাম এবং অক্লান্ত পরিশ্রম করলাম, শহীদ সাহেবের হুকুম মত।
০৫.
একটা ঘটনার দিন-তারিখ আমার মনে নাই, ১৯৪১ সালের মধ্যেই হবে, ফরিদপুর ছাত্রলীগের জেলা কনফারেন্স, শিক্ষাবিদদের আমন্ত্রণ জানান হয়েছে। তারা হলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম, হুমায়ুন কবির, ইব্রাহিম খাঁ সাহেব। সে সভা আমাদের করতে দিল না, ১৪৪ ধারা জারি করল। কনফারেন্স করলাম হুমায়ুন কবির সাহেবের বাড়িতে। কাজী নজরুল ইসলাম সাহেব গান শোনালেন। আমরা বললাম, এই কনফারেন্সে রাজনীতি আলোচনা হবে না। শিক্ষা ও ছাত্রদের কর্তব্য সম্বন্ধে বক্তৃতা হবে। ছাত্রদের মধ্যেও দুইটা দল হয়ে গেল। ১৯৪২ সালে আমি ফরিদপুর যেয়ে ছাত্রদের দলাদলি শেষ করে ফেলতে সক্ষম হলাম এবং পাকিস্তানের জন্যই যে আমাদের সংগ্রাম করা দরকার একথা তাঁরা স্বীকার করলেন। তখন মোহন মিয়া সাহেব ও সালাম খান সাহেব জেলা মুসলিম লীগের সভাপতি ও সম্পাদক ছিলেন।
১৯৪২ সালে মিস্টার জিন্নাহ আসবেন বাংলাদেশে, প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সম্মেলনে যোগদান করার জন্য। সম্মেলন হবে পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমায়। আমরা ফরিদপুর থেকে বিরাট এক কর্মী বাহিনী নিয়ে রওয়ানা করলাম। ছাত্রলীগ কর্মীই বেশি ছিল। সৈয়দ আকবর আলী সাহেবের বাড়িতে অভ্যর্থনা কমিটির অফিস করা হয়েছিল। আমি প্রায় সকল সময় শহীদ সাহেবের কাছে কাছে থাকতে চেষ্টা করতাম। আনোয়ার হোসেন তখন ছাত্রদের অন্যতম নেতা ছিলেন। তার সাথে কলকাতায় আমার পরিচয় হয়। শহীদ সাহেব আনোয়ার সাহেবকে খুব ভালবাসতেন। ছাত্রদের মধ্যে দুইটা দল ছিল। চট্টগ্রামের ফজলুল কাদের চৌধুরীও তখন ছাত্র আন্দোলনের একজন নেতা ছিলেন। ওয়াসেক সাহেব ও ফজলুল কাদের চৌধুরীর সাথে গোলমাল লেগেই ছিল। ওয়াসেক সাহেব ছাত্রদের রাজনৈতিক পিতা ছিলেন বললে অন্যায় হবে না। বহুদিন তিনি ‘অল বেঙ্গল মুসলিম ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। ছাত্রজীবন শেষ করেছেন বোধহয় পনের বছর পূর্বে। তবুও তিনি পদ ছাড়বেন না। কেউ তার মতের বিরুদ্ধে কথা বললেই তিনি বলতেন, “কে হে তুমি? তুমি তো ছাত্রলীগের সদস্য বা কাউন্সিলার নও; বের হয়ে যাও সভা থেকে।” প্রথমে কেউই কিছু বলত না তাকে সম্মান করে। প্রথম গোলমাল হয় বোধহয় ১৯৪১ বা ১৯৪২ সালে কুঁচুড়া সম্মেলনে। ফজলুল কাদের চৌধুরী ও আমরা ভীষণভাবে প্রতিবাদ করলাম, শেষ পর্যন্ত শহীদ সাহেবের হস্তক্ষেপে গোলমাল হল না। আমি ও আমার সহকর্মীরা ফজলুল কাদের চৌধুরীর দলকে সমর্থন করে বের হয়ে এলাম। তখন সাদেকুর রহমান (এখন সরকারের বড় চাকরি করেন) প্রাদেশিক ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, পরে আনোয়ার হোসেন সম্পাদক হন। বগুড়া সম্মেলনে আমরা উপস্থিত হয়েও সভায় যোগদান করি না, কারণ অল ইন্ডিয়া মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি মাহমুদাবাদের রাজা সাহেব ওয়াদা করলেন শীঘ্রই তিনি এডহক কমিটি করে নির্বাচন দেবেন। এডহক কমিটি করলেন সত্য, তবে তা কাগজপত্রেই রইল।