অন্যদিকে তুমি শরীরে-মনে বড় হয়ে উঠছ বিলেতে, বিলিতি মেয়েদের সঙ্গসুখ পাচ্ছ, আন্নার মতো মারাঠি মেয়েও এসেছে তোমার জীবনে, কেউ তোমাকে বলছে আমার দস্তানা চুরি করলে আমাকে চুমু খাবার অধিকার পাবে তুমি, আর কেউ তোমার উপর অকাতরে বর্ষণ করছে মন অধিকারের গোলাগুলি—সেই সব ছেড়ে, কিংবা ছাড়তে বাধ্য হয়ে তুমি বিয়ে করলে আমাকে!
কেন, রবি ঠাকুর, কেন?
সেই ‘কেন’-র উত্তর আমাকে তুমি দাওনি। দিতে পারোনি।
অন্য কেউও দেয়নি।
তবে সেই ‘কেন’-র উত্তর ছড়িয়েছিল ঠাকুরবাড়ির মেয়েমহলের নানা টিপ্পনিতে, আড়চোখের চাউনিতে, বিদ্রূপে, নানা কথাবার্তার চোরাস্রোতে।
যেমন করে ডুবুরি ডুব সাঁতার দিয়ে আহরণ করে সাগরতলার মণিমুক্তো, তেমনি করে আমিও পেয়েছি আমার গভীর ব্যথার নীলকান্তমণি—আমার সেই ‘কেন’র উত্তর।
০৩. নতুনদাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ
আমার ভাশুরদের মধ্যে সব থেকে সুন্দর কথা বলেন, কী গুণী, গান-বাজনা-লেখা, সবদিকে ওঁর প্রতিভা,—তিনি ওঁর নতুনদাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ।
যা সুন্দর দেখতে!
ওঁর চেয়েও সুন্দর!
তবে দেখলেই মনে হয় ভারি দুঃখী।
সব সময়ে মন খারাপ করে থাকেন। তেমন মেশেন না কারও সঙ্গে।
শুনেছি এক সময়ে খুব মিশুকে ছিলেন।
আমোদ-আহ্লাদ-গান-বাজনা-থিয়েটার, এইসব নিয়ে থাকতেন।
স্ত্রীর আত্মহত্যার পর থেকে উনি অন্য মানুষ।
আমি বরাবর এই অন্য মানুষটাকেই দেখেছি।
আগে যেরকম ছিলেন, সেই মানুষটি সম্পর্কে কত কথা শুনেছি। তাঁকে তো দেখলুম না কোনওদিন।
আমার সঙ্গে তো একেবারেই মিশলেন না কোনওদিন। হয়তো আমাকে এ-বাড়ির অপয়া বউ ভাবেন। তেমন ভাবাই তো স্বাভাবিক। আমার বিয়ের দিনেই শিলাইদহে মারা গেলেন আমার বড় ননদ সৌদামিনী দেবীর স্বামী সারদাপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়। বাবামশায় বিয়েতে অনুপস্থিত থাকলেন। আর আমার বিয়ের ক’মাস পরেই তো নতুন বউঠান আত্মহত্যা করলেন।
বরাবর একটা কথা আমার মনে হয়েছে।
ছোট বড় মুখে কথা হবে, তাই কথাটা কাউকে বলতে পারিনি।
কথাটা হল, ওঁর নতুনদাদার যদি একটি সন্তান হত, ওঁর জীবনটা অন্যরকম হতে পারত।
কেন সন্তান হল না?
সবাই দোষ চাপাল নতুন বউঠানের ঘাড়ে।
এ-ব্যাপারে মেয়েমানুষেরই যেন যত দোষ, বরাবর দেখেছি।
আমার ভাশুরেরও তো দোষ থাকতে পারত।
কে বলবে? সে কথা ভাবাও অন্যায়।
পরিবারের সবাই নতুন বউঠানের দিকেই ঢিল ছুড়লেন।
উনিও মনে-মনে নিজেকে বাঁজা ভেবে অপরাধী করে ফেললেন।
মনের কষ্ট কাকে জানাবেন?
কষ্ট জানাবার একটিই লোক সারা পরিবারে—
আমার স্বামী।
আমার বিয়ের পরে নতুন বউঠানের নিশ্চয় মনে হয়েছিল, একমাত্র বন্ধু, তাঁর প্রাণের রবি, সেও দূরে সরে গেল।
নতুন বউঠানকে দূর থেকে দেখতুম।
কাছে গিয়ে তাঁকে চেনবার জানবার সুযোগ আর হল কই?
আমিও এলাম রবি ঠাকুরের বউ হয়ে আর উনিও চলে গেলেন চিরদিনের জন্যে।
তা ছাড়া কাছে যাওয়ার সুযোগ হলেও দশ বছর বয়েসে মাত্র মাস তিনেকের মধ্যে কতটুকুই বা বুঝতে পারতুম তাঁকে?
শুধু এইটুকু মনে আছে, আমাকে উনি এতটুকু ভালোবাসতেন না।
যদিও তাঁর প্রিয় দেওরের জন্যে বউ পছন্দ করার দলের মধ্যে উনিও ছিলেন।
উনি যেতে চাননি।
নিশ্চয়ই এই কাজটি করতে ওঁর নানা কারণেই ভালো না লেগে থাকতে পারে।
তবু গিয়েছিলেন।
যেতে বাধ্য হয়েছিলেন বলেই মনে হয়। পিছনে ছিল বাবামশায়ের কড়া আদেশ। অনিচ্ছাসত্বেও গিয়েছিলেন বলেই হয়তো ধকল সহ্য করতে পারেননি।
খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।
আমাকে নিশ্চয় প্রিয়তম পুরুষ রবির বউ হিসেবে ওঁর পছন্দও হয়নি।
ওঁর দেওরটির বিয়ে হয়ে যাক, এটাই তো উনি চাননি।
আমি যদি সুন্দরী হতুম?
বা নিদেনপক্ষে কিশোরী?
তাহলে নিশ্চয়ই আরও খারাপ লাগত ওঁর।
নেহাত বালিকা এবং রোগা ডিগডিগে এক্কেবারে হেলাফেলার যোগ্যা গ্রামের গরিব ঘরের মেয়ে—এই যা রক্ষে!
কোথায় পঁচিশ বছরের সুন্দরী, বিদুষী, রবি ঠাকুরের প্রাণের মানুষ নতুন বউঠান আর কোথায় আমি ন’বছর ন’মাসের একরত্তি গ্রাম্য বালিকা—কোনও তুলনা হয় নাকি?
আগেই বলেছি, আমার রবি ঠাকুরের বয়েস তখন তেইশ।
ছ’ফুট চার ইঞ্চি লম্বা এক তরতাজা তরুণ, কী বলিষ্ঠ শরীর কী বলব!
আর নতুন বউঠান ছিপছিপে তরুণী। উনি যত ফরসা, নতুন বউঠান ততই শ্যামবর্ণ। কিন্তু কী যেন একটা কিছু নতুন বউঠানের ভিতরে ছিল, বিশেষ করে ওঁর চোখে, টেনে নেওয়ার শক্তি ছিল। উনি তো বলেন, নতুন বউঠানের চোখ উনি কখনও ভুলবেন না। একদিকে এইরকম এক বউদি, যাকে হাসলে ভারি সুন্দর দেখায়, যিনি তাকালে প্রাণে টান লাগে, যাকে দেখলেই অন্যদের থেকে অন্যরকম মনে হয়, আমার ভাষা নেই যে বোঝাই ঠিক কীরকম—আর একদিকে আমি বছর দশেকের ম্যাড়মেড়ে গ্রামের মেয়ে।
তবু আমিই রবি ঠাকুরের বউ!
আর নতুন বউঠান কেমন যেন ম্লান ছায়ার মতো একটা মানুষ—একদিন উনিই আমাকে বললেন, ছোটবউ, নতুন বউঠান কিন্তু একদমই এরকম ছিলেন না। ক’মাসের মধ্যে এরকম হয়ে গেছেন।
কীরকম ছিলেন উনি? জিগ্যেস করলুম আমার রবি ঠাকুরকে।
উনি বললেন, সে তুমি বুঝবে না। নাগপাশের মতো। যখন প্রথমবার বিলেত থেকে ফিরে এলুম, নতুন বউঠানের সঙ্গে দেখা হল, তখন তো মনে হয়েছিল, আবার আমার বাংলাদেশ, সেই ছাদ, সেই চাঁদ, সেই দক্ষিণে বাতাস আর সেই নতুন বউঠান, মনে হল নাগপাশের দ্বারা জড়িত বেষ্টিত হয়ে চুপ করে বসে থাকতে চাই, আর কিছু চাইনে।