কেন আত্মহত্যা করার চেষ্টা করলেন তিনি?
কারণ, ঠাকুরবাড়িতে তিনি কারও সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারেননি।
আমার মতো তিনিও ছিলেন এ-বাড়ির কাজের লোকের মেয়ে। তাঁর সঙ্গেও তাঁর স্বামীর বয়েসের অনেক তফাত।
তাঁকে তোমার নতুন দাদার যোগ্য স্ত্রী বলে কেউ মনে করতেন না। এমনকী তোমার নতুন দাদাও নন।
একমাত্র তুমি ছিলে তাঁর বন্ধু।
তাঁর একটিমাত্র মনের মানুষ।
একমাত্র তোমারই সঙ্গে গড়ে উঠেছিল তাঁর ভারি মধুর এক সম্পর্ক। তুমি যখন প্রথমবার বিলেত গেলে, তোমার বয়স সতেরো। তোমার নতুন বউঠান কুড়ি। তুমি তাঁকে দেড় বছরের জন্যে ফেলে রেখে গিয়েছিলে এমন এক পৃথিবীতে যেখানে প্রতি মুহূর্তে তিনি তোমার অভাব বোধ করেছেন এবং কষ্ট পেয়েছেন।
নতুন দেশে, নিত্য নতুন অভিজ্ঞতার মধ্যে তুমি কিন্তু অতটা কষ্ট পাওনি রবি ঠাকুর।
আমি অনেক ভেবেছি। এবং ভাবতে ভাবতে কিছু সত্যের সন্ধান পেয়েছি। আস্তে-আস্তে আমার চোখের সামনে থেকে পরদাটা সরে গিয়েছে।
আমি অনেকগুলি সিঁড়ি পেরিয়ে ধাপে-ধাপে তোমার আমার সম্পর্কের আসল জায়গাটায় পৌঁছোতে পেরেছি।
সেটা হল সত্যের তলানি।
যে-কথা বলছিলুম। তুমি বিলেত যাওয়ার আগে আমেদাবাদে গেলে তোমার মেজোদাদার কাছে। তিনি চাইলেন বিলেত যাবার জন্যে তোমাকে তৈরি করতে।
কেমন ভাবে তৈরি করা?
বিদেশকে যারা দেশের রস দিতে পারে সেইরকম মেয়েদের সঙ্গে তোমাকে মিলিয়ে দিয়ে তৈরি করা।
তোমাকে পাঠিয়ে দিলেন বম্বেতে বন্ধু ডাঃ আত্মারাম পাণ্ডুরঙের বাড়িতে থাকার জন্যে।
সেই বাড়িতে থাকে আত্মারামের সদ্য বিলেত ফেরত সুন্দরী কন্যা। এই মারাঠি মেয়ে শেখাবে তোমাকে বিলিতি বুলি আর আদবকায়দা।
কিন্তু সে তো তোমার প্রেমে পড়ল গো রবি ঠাকুর। তোমার প্রেমে কে না পড়বে বলো?
তুমিও পড়লে তার প্রেমে—সেটাই তো খবর।
সেই মেয়ের মারাঠি নাম ছিল আন্না।
তুমি ভালোবেসে তার নাম রাখলে ‘নলিনী’।
তুমি তাকে নিয়েই লিখলে তোমার কাব্য ‘কবিকাহিনি’।
তোমার বড়দাদা আমার বিয়ের পরে আমার আইবুড়ো নাম ভবতারিণী বদলে নতুন নাম রাখলেন ‘মৃণালিনী।’
কেন মৃণালিনী অনেক পরে জেনেছিলুম।
নলিনী-ই কি মৃণালিনী নয়? আমার নাম শুনলেই যাতে তোমার জীবনের প্রথম প্রেমিকার কথা তোমার মনে আসে, তাই আমার নাম হল ‘মৃণালিনী।’ আমি অন্য এক মেয়ের ছায়া হয়ে এলুম তোমার জীবনে।
প্রথম থেকেই আমার নিজের বলতে কিছুরইল না। মুছে দিলে তোমরাই।
নলিনীকে অবিশ্যি ভুলতে তোমার বেশি সময় লাগেনি।
তোমার মুখেই আমি নলিনীর গল্প শুনেছি।
সেই মেয়ে যে চাঁদনি রাতে তোমার খাটে একা এসে বলেছিল, আমার হাত ধরে টানো তো, দেখি টাগ-অফ-ওয়া’র কে জেতে—সেই মেয়ে যে তোমাকে বলেছিল, রাখলাম আমার হাতের দস্তানা তোমার সামনে, এবার আমি ঘুমিয়ে পড়ছি, এই সুযোগে যদি দস্তানাটা চুরি করতে পারো, তাহলে তুমি পাবে আমাকে চুমু খাবার অধিকার কী সাহসী মেয়ে গো! পারব কখনও অচেনা পুরুষকে এসব কথা বলতে?
তুমি তো তার প্রেমে পড়বেই। কিন্তু বিলেতে মেমসায়েব দেখে নলিনীকে গেলে ভুলে ক’দিনের মধ্যেই। অথচ ‘কবিকাহিনী,’ ‘ভগ্নহৃদয়’ তাকে নিয়েই লেখা।
নলিনীকে ভুললে কার প্রেমে পড়ে?
লুসি স্কটের প্রেমে পড়ে।
লন্ডনে যাঁদের বাড়িতে গিয়ে উঠলে তুমি সেই ভদ্রলোকের চার মেয়ে।
লুসিই ছোট মেয়ে।
তার সঙ্গে শুরু করে দিলে গানবাজনা-প্রেম। শুধু কি লুসি? তোমার মুখেই তো শুনেছি আরও অনেক নাম—মিস লং, মিস ভিভিয়ান, মিস মুল।
তুমি তো নতুন বউঠানকে জানিয়েও ছিলে, বিলেতে অপরিচিত মেয়ের সঙ্গে নাচতে তোমার মন্দ লাগে না। জানিয়েছিলে, যেদিকে পা বাড়াও সেদিকেই বিবিদের গাউন। জানিয়েছিলে, যেদিকে চোখ ফেরাও চোখ ঝলসে যায় মেয়েদের রূপে। জানিয়েছিলে, সকলের মুখে হাসি আর হাসতে হাসতেই এইসব বিলিতি মেয়েরা পুরুষের মন অধিকার করার যত প্রকার গোলাগুলি আছে, সব তারা অকাতরে নির্দয়ভাবে বর্ষণ করছে। জানিয়েছিলে, বিলেতে যে-ঘর যত পিছল সে-ঘর তত নাচার উপযুক্ত। জানিয়েছিলে, এই পিছল ঘরে পা কোনও বাধা পায় না, আপনাআপনি পিছলে আসে।
আমি কী করে জানলুম, তোমার নতুন বউঠানকে তুমি লিখেছিলে এইসব কথা?
এসব কথা তো ছাপার অক্ষরেই লেখা আছে। আর আমি তো বুঝতে পেরেছি, এসব লেখা তোমার নতুন বউঠানকেই লেখা চিঠি।
তুমিই লিখেছ নতুন বউঠানকে, এইসব মেয়েদের কেউ তোমাকে ডেকেছে ইশারায়, কেউ চাপল্যের মাধুর্যে। কারও কাছে পেয়েছ রোম্যান্টিক উষ্ণতা। কারও সঙ্গে একা বেড়াতে গেছ বনের পথে। কারও সঙ্গে নেচ্ছে। কারও সঙ্গে গেয়েছ। কেউ দিয়েছে স্পর্শসুখ। কেউ মনের তৃপ্তি।
তুমি তো নিজেই লিখেছ রবি ঠাকুর, তোমার চেহারাটা যে নেহাত মন্দ নয় একথা তুমি প্রথম টের পেলে বিলেতে।।
তুমি তো স্বীকার করেছ, তোমার বয়স হয়েছিল একটু দেরিতেই। ইঙ্গিতে বলেছ, বিলেতের মেয়েরাই তোমাকে প্রাপ্তবয়স্ক করল—তাই তো?
আমি তখন তোমার জীবন থেকে অনেক দূরে।
আমি তখন ফুলতুলি গ্রামে বছর পাঁচেকের শিশু। আরও বছর পাঁচেক পরে তোমারই সঙ্গে আমার বিয়ে হবে!
ভাবো একবার! কী এক অসম্ভব অবাস্তব ঘটনা ঘটল বলো তো?
একদিকে তোমার জীবনে ধ্রুবতারার মতো জ্বলজ্বল করছেন নতুন বউঠান কাদম্বরীদেবী।