একটা জলজ্যান্ত মানুষ, কী কম বয়েস, আত্মহত্যা করল!
কেন? সব চুপ! কেউ কিছু জানে না।
আমি বাতাসে কান পেতে জানতে পারছিলুম খুব আস্তে আস্তে আমার রবি ঠাকুর আর তাঁর নতুন বউঠানের বয়েস ছিল খুব কাছাকাছি।
নতুন বউঠান ছিলেন মাত্র দু-বছরের বড়। আর এ-বাড়িতে আমার স্বামী ছাড়া তাঁর কোনও বন্ধু ছিল না।
ওঁদের মনের মিল হয়েছিল।
ওঁদের সম্পর্কটা আমি খুব ধীরে-ধীরে অনুভব করেছিলুম—যেমন একটু-একটু করে আলো ফুটে ভোর হয়, সেইভাবে।
যেদিন তাঁর নতুন বউঠান চলে গেলেন, সেদিন অনেক রাত্তির পর্যন্ত উনি ঘরে এলেন না।
কোথায় উনি?
আমি চুপিচুপি ছাদে গিয়ে দেখি, উনি পায়চারি করছেন আর মাঝে-মাঝে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলছেন, কোথায় তুমি নতুন বউঠান, তুমি ফিরে এসো। আমি তোমাকে ছেড়ে বাঁচব কী করে?
আমি আর কখনও ওঁকে এমন উদভ্রান্ত দেখিনি। আমি কাঁদতে কাঁদতে একা ঘরে ফিরে এলুম।
শুরু করেছিলুম বিয়ের কয়েক বছর পরে শিলাইদহে একটি ঘটনার কথা মনে করে।
কিন্তু সেই ঘটনা চুলোয় গেল, কথায়-কথায় কোথায় চলে এসেছি—একেবারে আমার বিয়ের মাস তিনেকের মধ্যে!
লেখক না হলে এই হয়। খালি খেই হারিয়ে যায়। তা হোক। এই লেখা তো কেউ কোনওদিন ছাপবে না।
শুধু সময় কাটানোর জন্যে লিখছি।
মনের মধ্যে কথা জমিয়ে রেখে কোনও লাভ নেই।
মনের কথা লিখে ফেললে মন অনেক হালকা হয়ে যায়। আর মনের কষ্টও কমে যায়।
সেদিন হঠাৎ বৃষ্টি এল। আষাঢ় মাসের বৃষ্টি। উনি লেখা বন্ধ করে জানলার কাছে গিয়ে বসলেন।
বরাবর দেখেছি, বৃষ্টির সঙ্গে ওঁর খুব গভীর একটা সম্পর্ক। বৃষ্টি আর উনি যেন পরস্পরের মনের কথা বোঝেন।
আর কারো সঙ্গে বৃষ্টির এমন বন্ধুত্ব দেখিনি।
কতবার দেখেছি; শান্তিনিকেতনে দেখেছি, শিলাইদহে দেখেছি, সাজাদপুরে দেখেছি, বৃষ্টি এসেছে, উনি তাকিয়ে আছেন মেঘের দিকে, আকাশের মধ্যে যেন হারিয়ে গিয়েছেন, সেই সময়ে উনি একেবারে অন্য মানুষ, সংসারের বাইরের মানুষ।
গান লেখার সময়েও ওইরকম। অন্য কিছু লেখার সময় হয়তো তবু কথা বলা যায়।
কিন্তু বৃষ্টি আর গানের সঙ্গে উনি একাকার হয়ে থাকেন। তখন উনি আমাদের কেউ নন।
আমার কী সৌভাগ্য—এই দুই ভাবের মধ্যেই আমি ওঁকে কতবার কত কাছ থেকে দেখেছি।
আমি ওঁর কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। উনি ডুবে আছেন। টের পাননি। টেবিলের উপর ওঁর লেখার কাগজ। কলম। কী লিখছিলেন উনি? লেখা বন্ধ করে উঠে গিয়েছেন জানলার কাছে চেয়ারটিতে।
টেবিলের কাছে গিয়ে দেখি মুক্তোর মতো হাতের লেখায় ইন্দিরাকে একটি চিঠি লিখছেন।
কোথাও একটি কাটাকুটি নেই। কী এক তোড়ে বেরিয়ে এসেছে তাঁর মনের কথা! আমার সব চিঠিটা মনে নেই। কিন্তু তার ভিতরের কথাটা মনে আছে।
উনি লিখেছেন, যারা খুব অল্প অনুভব করে, অল্প চিন্তা করে, অল্পই কাজ করে, তাদের সংসর্গে মনের কোনও সুখ নেই। ঠিক এই ভাষায় লেখেননি, কিন্তু মোদ্দা কথাটা তাই।
চিঠির শেষে লিখছেন, আমাদের সমস্ত জীবনের সফলতাটা যে জায়গায় সেইখানে একটা প্রেমের স্পর্শ, একটা মনুষ্য-সঙ্গের উত্তাপ সর্বদা পাওয়া আবশ্যকনইলে তার ফুলে-ফলে যথেষ্ট বর্ণ গন্ধ এবং রস সঞ্চারিত হয় না। কথাগুলি আমার এমনভাবে মনে ধরল যে মুখস্থ হয়ে গেল!
উনি তো কখনও আমাকে এই ভাষায় এমন ভাবের চিঠি লেখেননি! কেনই বা লিখবেন?
আমি কি এমন চিঠির, এমন ভাব আর ভাষার যোগ্য? আমি কি দিতে পারব জীবনের সফলতার জায়গায় প্রেমের স্পর্শ? আমার সঙ্গের উত্তাপ?
আর দিতে যদি পারিও, আমার মতো অতি সাধারণ একটি মেয়ের প্রেমের কী দাম?
একবার ইচ্ছে হল, ওঁর কাছে গিয়ে দাঁড়াই, ঢুকে পড়ি ওঁর ভাবের ঘরে আর স্পষ্ট কণ্ঠে ওঁকে প্রশ্ন করি, সত্যি করে বলো, আমাকে বিয়ে করেছিলে কেন?
জিগ্যেস করতে পারিনি। পারলে তো আমি অন্য মেয়ে হতুম। বলা যায় না, এমন প্রশ্ন করতে পারলে হয়তো উনি আমাকে ওঁর প্রেমের যোগ্য ভাবতেন কোনওদিন।
আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলুম নিঃশব্দে।
কেন তুমি আমাকে বিয়ে করতে গেলে?
আমার প্রিয় রবীন্দ্রনাথ, কেনই বা তোমাকে আমি এ-প্রশ্ন করতে চেয়েছিলুম? এ-প্রশ্নের উত্তর, সঠিক উত্তর, তুমি কিছুতেই দিতে পারতে না।
সেই স্বীকারোক্তি তোমার পক্ষে করা সম্ভব নয়।
আমি কিন্তু জানি কেন তুমি বিয়ে করেছিলে আমাকে, তোমাদের বাড়ির এক গরিব কর্মচারীর অতি সাধারণ দশ বছরের কন্যাকে।
তোমার তখন বয়েস প্রায় তেইশ।
নতুন বউঠান তোমার জীবনে তখন একমাত্র ভালোবাসার মেয়ে, তোমার ধ্রুবতারা—তার বয়েস পঁচিশ, তাঁকে ছাড়তে বাধ্য হলে তুমি। আর বিয়ে করতে বাধ্য হলে ন’বছর ন’মাসের আমাকে!
কী দিতে পারতুম আমি?
কী-ই বা তোমার পাওয়ার ছিল আমার কাছে?
কেন তুমি বিয়ে করতে বাধ্য হলে, সে-গল্প আমি একটু-একটু করে বুঝতে পেরেছি।
কত মুখে কত কথা শুনতে-শুনতে বুঝেছি, তোমার জীবনে আমার জায়গাটা কোথায়।
তোমার সঙ্গে তোমার নতুন বউঠানের বন্ধুত্ব বলো, সম্পর্ক বলো, মনের দেয়ানেয়া বলল, ভালোবাসা বলল, তা যে কত গভীরে গিয়ে পৌঁছেছিল, সেকথাও আমি ক্রমশ বুঝতে পেরেছিলুম।
তোমার যখন দ্বিতীয়বার বিলেত যাওয়ার কথা হল—এবার বিলেত যাবে তুমি ব্যারিস্টার হতে—সেই খবর পেয়ে নতুন বউঠান আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পারেননি।