—প্রথম প্রথম তো কাঁদবেই। এত কম বয়েসে বিধবা হল। কিন্তু কী জানো ছোটবউ, ক্রমশই অভ্যস্ত হয়ে যেত। এ-বাড়িতে এত লোকজন। ওর এখন মানুষজনের সঙ্গ প্রয়োজন।
—ওকে কি ফিরিয়ে আনতে যাচ্ছ?
–দ্যাখা যাক।
—বাপের বাড়িতে গিয়ে যদি মেয়েটা একটু শান্তিতে থাকে, থাকুক না। এখুনি ওকে ফিরিয়ে আনতে হবে?
—তুমি বুঝবে না ছোটবউ। সাহানা ঠাকুরবাড়ির বউ। এই বাড়িই ওর জায়গা। ওর অন্য কোথাও মন বসলে সেটা ওর ভবিষ্যতের পক্ষে ভালো হবে না।।
আমি অন্যের মুখে শুনলাম, সাহানাকে এত তাড়াতাড়ি ফিরিয়ে আনার প্রয়োজন কেন হয়েছিল!
বিধবাবিবাহের বিরোধিতা করেছেন বাবামশায় আজীবন। কিন্তু তোমার নিজস্ব কোনও মত ছিল না?
তুমি তো আমাকে কতবার বলেছ, তুমি বিধবাবিবাহের পক্ষে। অথচ বাবামশায় দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে একটি কথাও বলার সাহস হল না তোমার।
আমি তোমাকে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করি।
খুব ভালোবাসি।
তাই তুমি যখন সাহানাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ফিরিয়ে আনার জন্যে এলাহাবাদে গেলে আমি বড় কষ্ট পেয়েছিলুম। লজ্জাও হয়েছিল।
তবে আমি জানতুম সাহানার বাপের বাড়ি তোমার কথায় মজে যাবে। আর সাহানা তো একরত্তি মেয়ে—ওর আবার মতামত আছে নাকি। আমার মনে এতটুকু সন্দেহ ছিল না, তুমি যখন ওকে আনতে যাচ্ছ, ও ঠিকই চলে আসবে। আর ওর বাকি জীবন বিধবা হয়েই কাটবে। তোমার সঙ্গে কথায়, যুক্তিতে, বোঝনোর ক্ষমতায় কে এঁটে উঠবে?
তুমি তো ভাষার ভগবান।
তোমার কথায় কী জাদু, তার কত প্রমাণ তো পেলাম সারাজীবন।
একটা জরুরি কথা বলতে ভুলে গিয়েছি। আমি অকৃতজ্ঞ নই। কথাটা বলতেই হবে। কথাটা হল, জোড়াসাঁকোর বাড়িতে আমি যখন খুব একা, সংসার সামলাতে হিমশিম খাচ্ছি, তখন আমার বড়ননদ সৌদামিনী কিছুদিন আমার সঙ্গে হাত মিলিয়ে হাল ধরেছিলেন। এবং কিছুদিনের মধ্যেই নিশ্চয়ই বুঝেছিলেন, কাজটি বড় সুবিধের নয়। বেশিদিন পারলেনও না।
মনে হল, আড়াল থেকে আঙুল নাড়লেন বাবামশায়। মেজোবউদিদি জ্ঞানদানন্দিনীরও যে ইশারা ছিল না এমনও তো ভাবতে পারিনে।
বাবামশায় এখন কলকাতায় থাকলে মেজোভাশুরের পার্ক স্ট্রিটের বাড়িতেই ওঠেন। জোড়াসাঁকোতে আর আসেন না।
আমার বড় ননদ বাবামশায়ের সেবা করার জন্যে পার্ক স্ট্রিটের বাড়িতেই চলে গেলেন।
বাবামশায় নিজেও চেয়েছিলেন সেটাই—তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যাটি তাঁর কাছেই থাকুক।
সুতরাং আমার ঘাড়ে জোড়াসাঁকোর সকল ভার চাপিয়ে বড় ননদ পিতৃআজ্ঞা পালন করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করলেন না।
তখন তো পার্ক স্ট্রিটের বাড়ি জমজমাট। যে-ভাশুটি রূপেগুণে আমার রূপবান গুণবান। স্বামীটির চেয়ে বিন্দুমাত্র কম নন, সেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথও সেখানে।
তবে স্ত্রী কাদম্বরীর আত্মহত্যার পরে তিনি ক্রমশ কেমন যেন হয়ে গেলেন।
মেজোবউঠানের খুব কাছের মানুষ হয়ে রইলেন। কিন্তু তোমার আমার কাছ থেকে ক্রমশই যেন দূরে সরে গেলেন। এর কারণ আমি ধীরে-ধীরে জানতে পেরেছি। তুমি কিন্তু আমাকে কিছু বলোনি।
এত বছর হয়ে গেল তোমার আমার। তবু তোমার সেই আড়াল গেল না।
তুমি এত বোঝে।
এইটুকু বোঝো না?
তোমার এক এবং অদ্বিতীয় জ্যোতিদাদার কথা যখন উঠলই, তখন তো তোমার নতুন বউঠানের কথা উঠতে বাধ্য।
কিন্তু আমি বলতে চাই না সেই বিষয়ে বিশেষ কিছু। তুমি যখন আড়াল করে রেখেছ, আড়ালেই থাক।
তবে একেবারে যে আমাকে কিছুই বলেনি, তাও তো নয়।
তুমি বলেছ তোমার মতো করে হয়তো সব কথাই।
একমাত্র তুমিই পারো এভাবে সমস্ত বলতে সেই সমস্তর মধ্যে আড়াল থেকেই যায়।
তুমি আমাকে বলেছিলে, তুমি নতুন বউঠানকে খুব ভালোবাসতে। আর বলেছিলে, নতুন বউঠানও তোমাকে খুব ভালোবাসতেন। সেই নতুন বউঠান কেন তোমার আমার বিয়ের ক’মাসের মধ্যেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেন?
কী এমন দুঃখ হল তাঁর?
যখন তিনি আত্মহত্যা করলেন, আমার বয়স তখন দশ।
কিছুই বুঝিনি।
একটা দৃশ্য মনে আছে।
তুমি আর তোমার জ্যোতিদাদা, দুজনে নতুন বউঠানকে ধরে তাঁকে দক্ষিণের বারান্দায় হাঁটাবার চেষ্টা করছ।
তিনি সামনের দিকে ঝুলে পড়ে ঘুমিয়ে পড়ছেন।
আর তোমরা দুজনে তাঁকে জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করছ।
কিন্তু কিছুতেই জাগিয়ে রাখতে পারলে না।
আমার মনে আছে তাঁকে।
ঠাকুরবাড়ির সব বউদের চেয়ে তাঁর গায়ের রং ময়লা।
আমার থেকেও।
কিন্তু সব থেকে সুন্দর তিনিই। তাঁর সঙ্গে আমার বেশি দেখা হয়নি। তিনি তো ঘর থেকে বেরোতেনই না। আমাকেও তুমি কোনওদিন নিয়ে যেতে না ওঁর ঘরে।
তুমি যেতে মাঝেমধ্যে। অনেকক্ষণ থাকতে। যখন ফিরে আসতে আমার কাছে, তোমার মন থাকত অন্য কোথাও।
আমি যে ঘরে আছি খেয়ালই থাকত না তোমার।
দু-একদিন সাহস করে জিগ্যেস করেছিলুম, কী কথা হল গো?
তুমি কোনও উত্তর দাওনি।
জিগ্যেস করেছিলুম, আমার একা যেতে ভয় করে, তুমি একদিন নিয়ে যাবে ওঁর ঘরে?
তুমি বললে, ওঁকে একা থাকতে দাও। ওঁকে তুমি বুঝবে না। যখন নতুন বউঠান আত্মহত্যার চেষ্টা করেও দুদিন বেঁচে থাকলেন, বউঠানের খুব অসুখ, জানতে চাইলুম কী হয়েছে? তুমি বললে, ডাক্তার তো দেখছে। শক্ত ব্যামো।
তারপর এ-বাড়িতে থাকতে-থাকতে, নানা গল্প, কানাঘুষো, উড়োকথা শুনতে-শুনতে এইটুকু অন্তত বুঝতে পেরেছি, নতুন বউঠান বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন, ওঁর কোনও ব্যামো হয়নি।