আপনাদের রবি ঠাকুর একদিন আমাকে হেসে বললেন, আমার দাদা পূর্ণ উন্মাদ। আর আমি অর্ধেক।
আমি বললুম, বালাইষাট, তুমি পাগল হতে যাবে কেন?
উনি বললেন, কবি মাত্রেই অর্ধোন্মাদ।
আমার ভাশুর যখন উন্মাদরোগে আক্রান্ত সেই অবস্থায় ওঁর একমাত্র পুত্র বলেন্দ্রনাথের জন্ম হল।
এবং বলেন্দ্র মারা গেল মাত্র ঊনতিরিশ বছর বয়েসে।
বলু আমাকে সংস্কৃত, ইংরেজি এইসব শিখিয়েছিল। ও ছিল আমার খুব বন্ধু। ওর মৃত্যুর পরে আমি আরও একা হলুম।
বলুর কথায় পরে আসছি। যতটুকু বলা যায়, ততটুকুই বলব বলুর আর আমার বন্ধুত্বের কথা। তবে এখন তো জোড়াসাঁকোর বাড়ির জটিল পরিবেশের কথা বলছি যার মধ্যে আমি একা বছরের পর বছর কাটিয়েছি। এবং বলা যেতে পারে, শেষ হয়ে গেছি।
ওঁকে পাশে পাইনি বলেই বড্ড একা থাকতে হল সারাজীবন। বলু মারা যাওয়ার পর বাবামশায় বেশ একটা নিষ্ঠুর কাণ্ড করলেন। আমি মন থেকে মেনে নিতে পারিনি। কিন্তু উনি বাবামশায়কে সমর্থন করেছিলেন। আমার মনের কষ্টটা বোঝেননি।
বলুর মৃত্যুর পরে বাবামশায় তাঁর শেষ উইলে পাগল ছেলে বীরেন্দ্রকে পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করলেন। কারণ দেখালেন, বলুর মৃত্যুর পরে বীরেন্দ্রর তো আর কোনও উত্তরাধিকারী নেই। তিনি নিজেও উন্মাদ। তা-ই তাঁকে সম্পত্তির ভাগ দেওয়া উচিত হবে না। তাঁর বিধবা স্ত্রী প্রফুল্লময়ীর কথা বাবামশায় একবারও ভাবলেন না। প্রফুল্লময়ীর জন্যে নির্দিষ্ট হল একশো টাকা মাসোয়ারা। প্রফুল্লময়ী অর্থচিন্তায় ভেঙে পড়লেন। জোড়াসাঁকোর পারিবারিক পরিবেশ কেমন যেন অন্ধকার আর ঘোরালো হয়ে উঠল।
উনি দূর থেকে তাঁর কতটুকু আঁচ করতে পেরেছিলেন, জানি না। আমার মনে হয়েছিল বাবামশায় প্রফুল্লময়ীর উপর অবিচার করলেন। আপনাদের রবি ঠাকুর কিন্তু বাবামশায়ের সিদ্ধান্তকেই সমর্থন করে আমাকে একটি চিঠিতে জানালেন, ন’বউঠানের এক ছেলে, সংসারের একমাত্র বন্ধন নষ্ট হয়েছে, তবু তিনি টাকাকড়ি, কোম্পানির কাগজ কেনাবেচা নিয়ে দিনরাত্তির যেরকম লেগে রয়েছেন তা দেখে সকলেই আশ্চর্য এবং বিরক্ত। চিঠি পড়ে আমার মনে হল অন্তত আমার স্বামীটি বেশ রেগেই রয়েছে। তবে আপনাদের রবি ঠাকুর এটাও জানালেন তিনি মনুষ্যচরিত্রের বৈচিত্র্য বিবেচনা করে ন’বউঠানের কাজকম্ম শান্তভাবে গ্রহণ করার চেষ্টা করছেন। আমার স্বামীর চিঠি পেয়ে এই প্রথম তাঁকে চিঠি লেখার খুব ইচ্ছে হয়েছিল। এবং সেই চিঠিতে তাঁকে একটি প্রশ্ন করতে চেয়েছিলুম।
কিন্তু চিঠি লিখিনি, প্রশ্নও করিনি।
সাহসে কুলোয়নি।
আমার এই অগোছালো কিন্তু একেবারে খাঁটি আত্মজীবনীতে সেই প্রশ্নটি আপনাদের রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশে লিখে রেখে গেলুম—তুমি কি ভুলে গিয়েছিলে যে তোমার পাগল দাদার একমাত্র ছেলে বলু যখন মারা গেল, সে রেখে গেল তার পনেরো বছরের বিধবা বউ সাহানাকে?
তার ভরণপোষণের দায়িত্ব কি ন’বউঠানের উপর এসে পড়ল না?
বাবামশায় সেকথা ভুলে গেলেন কী করে?
আর তুমিও টু শব্দটি পর্যন্ত করলে না!
তোমার এই ব্যবহারে আমি যতটা না অবাক হয়েছিলুম, তার থেকে লজ্জা পেয়েছিলুম অনেক বেশি।
আরও একটা ঘটনা ঘটল আমার চোখের সামনে।
সাহানা অভিমান করেই চলে গেল এলাহাবাদে তার বাপের বাড়িতে। সাহানার বাপ মেজর ফকির চাটুজ্যে জাঁদরেল মানুষ ছিলেন। তিনি পনেরো বছরের বিধবা মেয়েটির আবার বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলেন।
সাহানা বারো বছর বয়েসে বলুর বউ হয়ে আসে।
তিন বছরে তার কোনও বাচ্চা হয়নি। এই একটা সুবিধে ছিল। যেই না বাবামশায়ের কানে পৌঁছোল সাহানার বিয়ে দেবার চেষ্টা চলছে অমনি উনি যেন দপ করে জ্বলে উঠলেন।
উনি বিধবাবিবাহের একান্ত বিরোধী।
এছাড়া উনি মনে করলেন, ঠাকুরবাড়ির কোনও বিধবার অন্যত্র বিয়ে হলে তাঁর এবং বংশের মর্যাদাহানি হবে।
বাবামশায় তোমাকেই পাঠালেন এলাহাবাদে তাঁর দূত হিসেবে। তোমার একমাত্র কাজ এই বিয়ে বন্ধ করে পনেরো বছরের সাহানাকে জোড়াসাঁকোর বাড়ির জেলখানায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা।
আমার মনে হয়, তোমার মেজোদাদাকে যদি বাবামশায় এই কাজটি করতে বলতেন, তিনি প্রতিবাদ করতেন।
একমাত্র তাঁরই মধ্যে আমি বাবামশায়ের সঙ্গে স্পষ্ট কথা বলার সাহস দেখেছি। তোমার ভাইদের মধ্যে এ-ব্যাপারে তিনি একা। তার অবিশ্যি একটা বড় কারণ হল, তিনি প্রথম ভারতীয় আইসিএস, তাঁর মাসে অনেক টাকা বেতন, তিনি বাবামশায়ের তহবিল থেকে পাওয়া হাতখরচের উপর নির্ভর করেন না।
বাবামশায় যেই তোমাকে এলাহাবাদ যেতে বললেন অমনি তুমি শুড়শুড় করে এলাহাবাদ ছুটলে।
ঠিক যেমনি বাবামশায়ের কথায় আমাকে শুড়শুড় করে বিয়ে করলে। আমাকে বিয়ে করাটা তো স্রেফ পিতৃআজ্ঞা পালন। তাই না?
কেন বিয়েটা করেছিলে বলো তো?
তুমিও কষ্ট পাচ্ছ। আর আমি? সেকথা ছাড়ো। অন্তত আপাতত। পরে তো আসতেই হবে সেকথায়। এখন যে কথা বলছিলুম—তুমি চলে গেলে এলাহাবাদে। কী জন্যে এলাহাবাদে যাচ্ছ, ঠিক করে আমাকেও জানাওনি।
আমি জিগ্যেস করেছিলুম।
তুমি বললে, একবার সাহানাদের বাড়িতে যেতে হচ্ছে।
—সাহানার বাপের বাড়ি! সে তো এলাহাবাদে। তার ওখানে যাওয়ার কী দরকার পড়ল?
–বাবামশায়ের আদেশ।
–মেয়েটা এ-বাড়িতে ভালো ছিল না। খুব একলা হয়ে গিয়েছিল। সারাক্ষণ কাঁদত।