ওঁর বিয়ের গল্প থাকবেই বা কী করে?
আমার মতো অতি সাধারণ অল্প শিক্ষিত একটি গ্রাম্য বালিকার সঙ্গে বিয়ের গল্প তো না থাকাই স্বাভাবিক।
কিন্তু আমার বিয়ের মস্ত বড় গল্প।
রবি ঠাকুরের সঙ্গে বিয়ে—গল্প থাকবে না?
আমার সমস্ত জীবনটাই তো আমার বিয়ের গল্প। আমার বিয়ে হল প্রায় দশ বছর বয়সে।
রবি ঠাকুরের স্ত্রী হয়ে থাকলুম প্রায় উনিশ বছর।
আর তো কিছু নেই আমার জীবনে—তাঁর একের পর এক সন্তানের মা হওয়া এবং তাদের বড় করা এবং ক্রমশ একা আর অসুস্থ হয়ে যাওয়া ছাড়া।
না, আরও আছে। সেই কথাটাই বড় কথা।
আছে আমার পরিচয়ের গৌরব, মহিমা।
আমি ক্রমেই বুঝতে পারছি, তেমন কিছুই না করেও আমি অমরত্বে উত্তীর্ণ হতে চলেছি।
ওঁর আলোই আমার আলো।
ওঁর দীর্ঘ যাত্রা আর হয়ে ওঠার ইতিহাসে আমার আসন চিরস্থায়ী।
আমার মতো এত কাছ থেকে ওঁকে তো আর কেউ দেখেনি।
সেই সৌভাগ্য তো শুধু আমার।
আমার উপর ঈশ্বরের করুণার শেষ নেই।
সব দিক থেকে কত সাধারণ, তুচ্ছ আমি।
তবু আমিই দেখতে পেলুম চাঁদের উলটো পিঠ। এ তো ঈশ্বরের আশীর্বাদ!
সেই রবি ঠাকুরকে ক’জন জেনেছেন, চিনেছেন, আমি যাঁকে চিনি, জানি।
আগেই বলেছি আমি লিখতে জানি না। উনি কী সুন্দর সাজিয়ে-গুছিয়ে মনের কথা বলেন।
আমি কিছুতেই পারিনে।
ওঁর সঙ্গে ঘর করলুম–যদি একে ঘর করা বলে—যা হোক, কাটালুম তো এতগুলি বছর একসঙ্গে কিন্তু কিছুতেই লেখার ব্যাপারটা রপ্ত করতে পারলুম না।
কিন্তু তবু, যত শারীরিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়ছি, যতই আর সংসারের ভার বহন করতে পারছিনে, যতই খুব একা লাগছে, ততই মনে হচ্ছে কিছু একটা লিখে সময় কাটাই।
দেখেছি, লিখলে বেশ সময় কেটে যায়। কিন্তু কী লিখি?
কেন, নিজের কথা।
আমি তো লেখক নই ওঁর মতে, যে বানিয়ে বানিয়ে লিখব।
নিজের কথা লিখি তো। বানাতে হয় না। একেবারে রেডি মেড গপ্পো।
নিজের কথা লিখি কীভাবে?
আমার দিক থেকে আমি আমার জীবনটাকে যেভাবে দেখেছি, সেইভাবে। সেইটেই লিখে ফেলি।
সেই দেখাটা আপনাদের রবি ঠাকুরের মতো নাও হতে পারে। তানা হওয়াই তো স্বাভাবিক।
উনি যদি লেখেন কোনওদিন আমাদের কথা, আমাদের নিয়ে ওঁর জীবনের কথা লিখবেন কি কোনওদিন? সে-লেখা তো ছাপার অক্ষরে বেরোবে, সবাই পড়বে। একেবারে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে, লেখার মতো লেখা। রবি ঠাকুরের লেখা বলে কথা। আমাদের চেয়ে লেখাটাই তখন বড় হয়ে উঠবে! আমি তো আর ছাপাবার জন্যে লিখছি না। লুকিয়ে রাখার জন্যে লিখছি।
যেমন ওঁকে লেখা আমার চিঠি—সেসব চিঠি আমি তো জানি, আমার সঙ্গে চিতায় উঠবে। কেউ কোনওদিন খুঁজে পাবে না তাদের। এই লেখাটার ভাগ্যে কী আছে কে জানে!
আমার বিয়ের বেশ ক’বছর পরে। উনি শিলাইদহে জমিদারির দেখাশোনা নিয়ে ব্যস্ত।
কত কী লিখছেন। গল্প, কবিতা, গান।
ওঁর কাজ আর খ্যাতি ক্রমশই বাড়ছে। আমি তো তেমন কিছু বুঝি না। দূর থেকে শুধু ওঁর মঙ্গল চাই। উনি দূরে আছেন। মন কেমন করে। কতদিন দেখা হয় না। কিন্তু এও ভাবি, দূরে আছেন বলেই ভালো আছেন।
আপন মনে কাজ করতে পারছেন।
জোড়াসাঁকোর বাড়িতে বিশেষ করে মেয়েমহলে কূটনীতির শেষ নেই।
শুধু সাংসারিক মারপ্যাঁচ।
যে যার নিজের স্বার্থ নিয়ে আছে।
সেই খেয়োখেয়ির মধ্যে আমি পচছি।
যতখানি পারি মানিয়ে চলার চেষ্টা করি।
মাঝেমধ্যে মনে হয় সংসারের, ছেলেমেয়েদের সব দায়িত্ব কি শুধুই আমার?
ওঁকে কি কখনও পাশে পাব না?
বলতে গেলে আমিই এখন বাড়ির গিন্নি, যদিও আমি কিন্তু এ-বাড়ির ছোটবউ।
ওঁকে সুবিধে-অসুবিধে জানাবার উপায় নেই।
উনি দিনরাত ভেসে চলেছেন পূর্ববাংলার নদীপথে।
পদ্মার চরে, কোনও অজানা প্রান্তরের পাশে উনি বোটের মধ্যেই দিন কাটাচ্ছেন।
কখনও ইছামতীতে। কখনও দীঘাপতিয়ার জলপথে। কখনও সুদূর নোয়ালঙ্গে একা।
তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের কোনও উপায় নেই।
কখনও হয়তো তাঁর চিঠি এল কালিগ্রাম থেকে।
তারপর খবর আসে তিনি নাটোরে, তিনি পতিসরে, তিনি কুষ্টিয়ায়! আমি যখন নিজের কথা ভাবি তখন দেখি পনেরো বছর ধরে আমি আসলে জোড়াসাঁকোর বাড়ির কাজের লোক হয়ে গিয়েছি।
না হয়ে উপায় বা কী?
বাড়ির বড়বউ সর্বসুন্দরী বহুকাল হল মরে বেঁচেছেন।
বড়বউ মানে আমার বড়ভার দ্বিজেন্দ্রনাথের স্ত্রী।
আমার মেজোজা জ্ঞানদানন্দিনী, মানে সত্যেন্দ্রনাথের বউ, তিনি তো বিলেত ফেরত মেমসাহেব, প্রথম ভারতীয় আইসিএস-এর স্ত্রী বলে কথা, তিনি জোড়াসাঁকোর সংসার ছেড়ে থাকেন সায়েবপাড়া পার্কস্ট্রিটে। এলাহি ব্যাপার। বাবামশায় আজকাল কলকাতায় এলে ওখানেই থাকেন। মেজোজায়ের এক ছেলে এক মেয়ে।
সুরেন আর ইন্দিরা।
আর একটি ছেলে হয়েছিল। ভারি মিষ্টি দেখতে। নাম দেওয়া হয়েছিল কবীন্দ্র। তবে সবাই ডাকত চোবি বলে। সে বিলেতে মারা গেল দু-বছর বয়েসে। বোধহয় বিলেতের ঠান্ডা সহ্য করতে পারেনি।
এবার আসি আমার সেজোজানীপময়ীর কথায়।
আমার সেজোভাশুর হেমেন্দ্রনাথ মারা গিয়েছেন চল্লিশ বছর বয়সে।
এগারোটি ছেলেপুলে নিয়ে নীপময়ী বিধবা। এবং বিধবা হওয়ার পর থেকে তিনি সংসারের কুটোটি নাড়েন না। ধম্মকম্ম নিয়ে আলগোছা হয়ে থাকেন একপাশে।
আমার আরও এক জা আছে। ইনি আমার শ্বশুরমশায়ের চতুর্থ পুত্র বীরেন্দ্রনাথের স্ত্রী প্রফুল্লময়ী। প্রফুল্লময়ী নীপময়ীর ছোটবোন। নীপময়ীর তো বিয়ে হয়েছে। হেমেন্দ্রনাথের সঙ্গে। পরের ভাই বিয়ে করলেন নীপময়ীর ছোটবোন প্রফুল্লময়ীকে। তার কারণ, এঁদের বাবা হরদেব চাটুজ্জ্যে আমার শ্বশুরমশায়ের খুব ভক্ত ছিলেন। অতএব ভক্তের দুই কন্যাকে দুই ছেলের বউ করে নিয়ে এলেন বাবামশায়। ভাগ্যে সুখ সইল না। হঠাৎ পাগল হয়ে গেলেন প্রফুল্লময়ীর স্বামী বীরেন্দ্রনাথ।