কোথায় গেল তাঁর ভাষার গুণ, নরম-নরম ভাব?
ইন্দিরাকে কখনও তিনি এরকম ভাষায় চিঠি লিখেছেন?
আমার কী ভাগ্য! আমি রবি ঠাকুরের বউ!
আমি চিনেছি, জেনেছি এক অন্য রবীন্দ্রনাথকে।
যে-রবীন্দ্রনাথের পরিচয় পৃথিবীর আর কোনও মেয়ে পায়নি।
একবার ওঁকে চিঠি লিখলুম, জোড়াসাঁকোর বাড়িতে কিছু ভালো গব্যঘৃত পাঠাবার জন্যে।
উত্তরে উনি লিখলেন সাজাদপুর থেকে–আমি কোনওদিন ভুলব না সেই চিঠি–
আচ্ছা, আমি যে তোমাকে এই সাজাদপুরের সমস্ত গোয়ালার ঘর মন্থন করে উৎকৃষ্ট মাখনমারা ঘেৰ্ত্ত সেবার জন্যে পাঠিয়ে দিলুম তৎসম্বন্ধে কোনও রকম উল্লেখমাত্র যে করলে না তার কারণ কি বলো দেখি? আমি দেখছি অজস্র উপহার পেয়ে পেয়ে তোমার কৃতজ্ঞতা বৃত্তিটা ক্রমেই অসাড় হয়ে আসছে। প্রতি মাসে নিয়মিত পনেরো সের করে ঘি পাওয়া তোমার এমনি স্বাভাবিক মনে হয়ে গেছে যেন বিয়ের পূর্বে থেকে তোমার সঙ্গে আমার এই রকম কথা নির্দিষ্ট ছিল। তোমার ভোলার মা যখন আজকাল শয্যাগত তখন এ ঘি বোধহয় অনেক লোকের উপকারে লাগচে। ভালোই তো। একটা সুবিধা, ভালো ঘি চুরি করে খেয়ে চাকরগুলোর অসুখ করবে না।
কী মনে হয়? আপনাদের চেনা রবীন্দ্রনাথ? তিনি এই ভাবে ও ভঙ্গিতে কথা বলতে পারেন! বিশ্বাস করতে একটু কষ্ট হচ্ছে তো? আমি মা হিসেবে কতদূর অপদার্থ সেকথাও একটি চিঠিতে জানাতে উনি কসুর করলেন না।
আমি যশোর জেলার ফুলতুলি গ্রামের মেয়ে।
বাঙাল তো বটেই। তার উপর আবার আমার বাবা বেণীমাধব জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির সেরেস্তার কর্মী।
সত্যি কথা বলব?
এমন অসম বিয়ে হওয়া উচিত নয়।
রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী হওয়ার কোনও যোগ্যতাই আমার নেই। না বংশমর্যাদায়। না শিক্ষায়।
একটি চিঠিতে ওঁর ভেতরের কথাটা দপ করে জ্বলে উঠল—
একেই তো বাঙাল। ছিঃ, ছেলেটাকে পর্যন্ত বাঙাল করে তুললে গো।
এইভাবে, আসতে-আসতে অন্য এক রবি ঠাকুরকে আমি জানতে পেরেছি। আমি রবি ঠাকুরের বউ না হলে এই মানুষটিকে আমি চিনতেই পারতুম না।
আমার কোনও রসবোধ নেই, একথা উনি নানাভাবে আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন।
কিন্তু আগেই বলেছি রসবোধ যাদের নেই, তারা পাকা হয় হিসেবপত্তরে। আমি আরও একটি হিসেব করেছি।
সেই হিসেব এইরকম—
আমার প্রথম সন্তানের জন্মের দু-বছর দু-মাস পরে জন্মাল আমার দ্বিতীয় সন্তান। বেলার পরে রথী। ঠিক তিন বছর পেরোতে-না-পেরোতেই আমার তিন নম্বর, রেণুকা। আবার দু-বছর কয়েক মাস, আমার চার নম্বর মীরা। মীরা জন্মের প্রায় পরে পরেই পেটে এল আমার পাঁচ নম্বর, শমী। শমীই রবি ঠাকুর আর আমার শেষ সন্তান—তাই তো জানেন আপনারা? একটু ভুল জানেন।
একটা অন্য গল্প আছে।
আমার সর্বনাশের গল্প।
কিন্তু আপনারা রস পাবেন। ভালোই লাগবে। এ-গল্পটা তিনজন জানি।
আমি।
উনি।
হেমলতা ঠাকুর।
হেমলতা মানে আমার বড়ভাশুর দ্বিজেন্দ্রনাথের বড় ছেলে দ্বিপেন্দ্রনাথের দ্বিতীয় বউ। আমার ভাশুরপো-বউ।
হেমলতা আমার খুব বন্ধু। এক্কেবারে আমার সমবয়সি। দুজনেই জন্মেছি ১৮৭৪-এ।
ওকে সব বলেছি। ঘটনাটা ঘটেছে সম্প্রতি।
আমি শান্তিনিকেতনে।
ঘনঘোর বর্ষা।
বোলপুরের মুন্সেফবাবুর বাড়ি নেমন্তন্ন খেতে গিয়েছিলুম। এ-বছরেই অর্থাৎ ১৯০২-এর আষাঢ় মাসে। বর্ষার জলে ওদের বাইরের সিঁড়িটা বেশ পেছল হয়েছিল।
পা পিছলে পড়লুম।
পেটে চোট লাগল।
আমার তখন ‘কয়েক মাস।’
আপনাদের রবি ঠাকুর আমাকে আরও একবার কৃপা করেছিলেন তো। বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে গেল।
আর আমার যা হবার তাই হল। সর্বনাশ। রক্ত আর থামে না।
আমার বয়েস আঠাশ।
আমার বিয়ের বয়েস উনিশ।
আমার আর বাঁচার ইচ্ছে নেই।
শক্তিও নেই।
সমস্ত জীবনটাই কেমন আবছা মনে হচ্ছে।
কেন জন্মেছিলুম?
কেন এত কষ্ট পেলুম?
রাতে ঘুম আসছে না আমার।
সমস্ত শরীরে জ্বালা।
ঘর অন্ধকারে।
সেই অন্ধকারে উনি আর আমি।
আমি বিছানায় মরা পাতার মতো শুয়ে আছি।
উনি বসে-বসে আমাকে হাত-পাখার বাতাস করছেন। উনি অনেক রাত পর্যন্ত আমাকে বাতাস করেন। আমি শুতে বলি।
কিছুতেই কথা শোনেন না।
হঠাৎ বললেন, ছোটবউ, একটা কথা তোমার কাছে স্বীকার করতে প্রাণ চাইছে।
তুমি আমার সঙ্গে এতদিন ঘর করলে, নিশ্চয় বুঝেছ, ভিতরে একটা জায়গায় আমি নির্মম।
—না গো, তুমি নির্মম নও। তুমি খুব দয়ালু, খুব ভালো। কত যত্ন করছ আমাকে।
না ছোটবউ, আমি নির্মম, আমি অনাসক্ত। কেন জানো?
—না তো।
শোনো। আমি জানি আমি অনেক দূরের যাত্রী। অনেক পথ পেরোতে হবে আমাকে।
—তাই নির্মম হতে হবে?
—এই দীর্ঘ যাত্রার জন্যেই বন্ধুবান্ধব, সংসার, তোমাকে, আমার ছেলেমেয়েদের…আমি কোনও কিছু আঁকড়ে ধরিনি।
—কোথায় পৌঁছতে চাও তুমি?
—জানি না। শুধু জানি অনেক পথ পেরোতে হবে। আটকে পড়লে চলবে না।
—তুমি এগিয়ে যাও। আমার ভালোবাসা আর শুভেচ্ছা রইল।
–ছোটবউ, আমার মধ্যে একটা প্রবল শক্তি আছে। আমি জানি, সেই শক্তি বিচিত্র পথে ধীরে-ধীরে নিজেকে প্রকাশ করবে। ভিতরে ভিতরে আমি যদি নিষ্ঠুর না হই তাহলে সেই শক্তিকে আমি বাঁচিয়ে রাখতে পারব না। যদি জড়িয়ে পড়ি, আমার সব নষ্ট হয়ে যাবে।
অন্ধকারের মধ্যে আমার গাল বেয়ে নামল চোখের জল। উনি দেখতে পেলেন না। মনে-মনে বললাম, আমার রবি ঠাকুর, আমি অন্তত তোমাকে খুব তাড়াতাড়ি মুক্তি দেব।
০২. বিয়ের কোনও গল্প নেই
উনি বলেছেন, ওঁর বিয়ের কোনও গল্প নেই।