-তোমার কাকা-জ্যাঠাদের অনুমতি নিয়েছ? জিগ্যেস করলুম। জানতুম বিশেষ করে রবিকাকার অনুমতি ছাড়া বলু একাজে হয়তো হাত দেবে না।
বলু বলল, রবিকাকা তেমন উৎসাহী বলে মনে হল না।
বলুর সঙ্গে আমার এসব কথা হচ্ছিল ও যখন আমাদের সঙ্গে শিলাইদহে, সেই সময়ে।
আপনাদের রবি ঠাকুর তখন অন্য ভাবধারায় চলছিলেন। জোড়াসাঁকোতে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর জন্যে তৈরি হয়েছিল গৃহবিদ্যালয়। সেখানে ইস্কুলের নিয়মরীতি ঠিক মানা হত না। এক ধরনের আবাঁধা শিক্ষাব্যবস্থা বলা যায়।
আমাকে উনি জোড়াসাঁকো থেকে ছেলেমেয়ে সমেত উপড়ে নিয়ে গিয়ে ফেললেন শিলাইদহে। সেখানেই চালু করলেন নতুন এক গৃহবিদ্যালয়। যেখানে আমার ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখতে লাগল। স্বভাবতই ব্রহ্মবিদ্যালয় সম্পর্কে বলুর উৎসাহে তিনি জল ঢেলে দিলেন।
বলু শিলাইদহ থেকে কলকাতা ফিরে আসার দিন দুই আগে আমার সঙ্গে একা বসেছিল বারান্দায়।
হঠাৎ আমার হাতটি ওর বুকের মধ্যে ধরে বলল, তুমি জানো, আমি একেশ্বরবাদী।
আমি কী করব, কী বলব ভেবে পেলুম না। আমার শরীর কেমন যেন অবশ হয়ে এল। বুক ভিজে গেল ঘামে।
বলু বলল, কথা দাও, মনে-মনে আমার সঙ্গে থাকবে। আমি কলকাতায় ফিরে একাই কাজে নামছি। জানব, তুমি আছ সঙ্গে।
–কোন কাজ?
—একেশ্বরবাদ প্রচারের জন্য ব্রহ্মবিদ্যালয় স্থাপনের কাজ। ঠাকুরদার ইচ্ছে তো তাই ছিল।
বলেন্দ্রনাথের কল্পনায় যেমন ছিল, ঠিক তেমনি একটি ব্রহ্মবিদ্যালয়ভবন তৈরি হল শান্তিনিকেতনে।
কিন্তু ততদিনে বলু চলে গেছে।
কে দ্বার-উদঘাটন করলেন সেই ভবনের?
কে আবার বলুর জ্যাঠামশাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
কী বললেন তিনি?
বললেন অনেক কথা—বললেন এতদিনে পূর্ণ হল তাঁর পিতা দেবেন্দ্রনাথের সংকল্প।
শুধু একটিবারও একটি নাম উচ্চারণ করলেন না।
বলেন্দ্রনাথের নাম—যে বলু ছাড়া ব্রহ্মবিদ্যালয় কোনওদিন তৈরিই হত না তার নামটিই ভুলে গেলেন আমার মেজোভাশুর!
আমি অবিশ্যি বলুর পাশে দাঁড়াতে পারিনি। ব্রহ্মবিদ্যালয়ের দ্বার-উদঘাটন অনুষ্ঠানেও আসতে পারিনি।
আমি তখন শিলাইদহের নির্বাসনে।
আপনাদের রবি ঠাকুর আমাকে পরিষ্কার বলে দিলেন, কলকাতার ভিড়ে আমার জীবনটা বড় নিষ্ফল হয়ে থাকে। কাজেই আমার জন্যে তোমাকে এই নির্বাসনদণ্ড গ্রহণ করতেই হবে। তুমি নিশ্চয়ই চাইবে না, আমি কলকাতায় নিজের সমস্ত শক্তিকে গোর দিয়ে বসে থাকি।
সত্যিই তো! কী করে তা চাই? আমি যে রবি ঠাকুরের বউ। আমার পক্ষে কী করেই বা বলুর সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করা সম্ভব হত?
এই ঘটনার মাস ছয় পরে, বাইশে ডিসেম্বর।
রবীন্দ্রনাথ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করলেন ব্রহ্মবিদ্যালয়!
তিনি বললেন, এই কাজে তিনি পিতার অনুমতি নিয়েছিলেন এবং এই কাজটিকে তিনি ‘পিতার আরদ্ধ সম্পাদন’ বলে কী সুন্দর ব্যাখ্যা করলেন।
আমার শুধু বলুর কথা মনে পড়ে চোখে জল এল।
আমি বলুকে মনে মনে প্রণাম করলাম। আর তার কপালে চুমু খেলাম। আর তার মাথাটি বুকের মধ্যে ধরে খুব কাঁদতে লাগলাম। হে আমার রবীন্দ্রনাথ, তুমিও ব্রহ্মবিদ্যালয়ের উদঘাটন উৎসবে একটিবারও বলুর নামটি উচ্চারণ করলে না!
কেন এত রাগ গো তোমার ওর ওপর?
তোমাকে একটি কথা জানিয়ে যাই রবি ঠাকুর। তোমাদের ব্রহ্মবিদ্যালয়ের দ্বার-উদঘাটন যখন চলছে আর যখন তুমি তোমার ভাষণ পাঠ করছ, আমি একা গৃহকোণে বসে গাইছিলুম বলুর লেখা একটি গান—ওই আমাকে শিখিয়েছিল আর বলেছিল এই গানটি আমার গলাতেই ওর সবচেয়ে শুনতে ভালোলাগে—
অসীম রহস্যমাঝে কে তুমি মহিমাময়!
জগৎ শিশুর মতো চরণে ঘুমায়ে রয়।
অভিমান অহংকার মুছে গেছে নাহি আর
ঘুচে গেছে শোকতাপ, নাহি দুঃখ নাহি ভয়।
কোটি রবি শশী তারা, তোমাতে হতেছে হারা
অযুত কিরণ ধারা তোমাতে পাইছে লয়।
১১. কলকাতায় জোড়াসাঁকোর বাড়িতে
আমাকে ওরা কলকাতায় জোড়াসাঁকোর বাড়িতে নিয়ে এসেছে।
আমি বেশ বুঝতে পারছি, এই বাড়িরই সব দায়িত্ব পালন করতে-করতে আর সন্তানের জন্ম দিতে দিতে, আর তাদের বড় করতে-করতে আমি মৃত্যুর দরজায়। আমি চোখে ভালো দেখতেও পাচ্ছি না।
আমার হাত কাঁপছে। নিশ্বাসের কষ্ট হচ্ছে।
তবু দু-একটা কথা এখনও লিখতে বাকি। আমার নিঃসঙ্গ পৃথিবীতে শেষ দুটি বন্ধু পেয়েছিলুম–
আমার দুই মেয়ে, মাধুরীলতা (বেলা) আর রেণুকা।
গত বছর ১৫ জুন রবি ঠাকুর মাধুরীলতাকে জোর করে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে তার বিয়ে দিয়ে দিয়েছে খুব ভেবেচিন্তে! কার সঙ্গে? সেই বিহারীলাল চক্রবর্তীর ছেলের সঙ্গে, যে বিহারীলাল ছিলেন নতুন বউঠানের ভক্ত বন্ধু!
বেলার বয়স মাত্র পনেরো।
আমি রেণুকাকে বুকে করে বেঁচে ছিলুম।
বেলার বিয়ের মাত্র একমাস চব্বিশ দিন পরে ও তাকেও কেড়ে নিল আমার বুক থেকে।
বিয়ে দিয়ে দিল মাত্র দশ বছর বয়সে।
কারণ বাবামশায় ১৮৯৯-এর ৮ সেপ্টেম্বর তাঁর শেষ উইল করেছেন। সেই উইল অনুসারে বাবামশায় বেঁচে থাকতে থাকতে মেয়েদের বিয়ে দিতে পারলে বিয়ের খরচের প্রায় সবটাই পাওয়া যাবে জোড়াসাঁকোর তহবিল থেকে! কী চমৎকার হিসেব!
আমার কোলের ছেলে শমী, মাত্র ছ’বছর বয়েস, কী দেখতে ইচ্ছে করছে আমার।
ওকে কতবার বললুম, যাওয়ার আগে শমীকে একটিবার দেখে যাই, ওকে নিয়ে এসো!