তবু ভয় করল কেন?
সে কলকাতায় ফিরে গেল।
তার রোজ-রোজ জ্বর হতে লাগল।
তার অসুখ বাড়তেই লাগল।
আমাকে আমার বর কিছুতেই কলকাতায় যেতে দিল না।
আমি শিলাইদহে।
আমি নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়ে বললুম, আমি কলকাতা যাবই।
কিন্তু যেতে পারলুম কই?
তার আগেই তো তার মৃত্যুর খবর এল আমার কাছে।
মাগো! আমার তো কোনও বন্ধু নেই।
সেই ছিল আমার একমাত্র বন্ধু।
সে—আমার পাগল ভাশুর বীরেন্দ্রনাথের একমাত্র সন্তান। বলু। বলেন্দ্রনাথ।
মাত্র ঊনতিরিশ বছর বয়সে চলে গেল।
১০. বলুর আমি কাকিমা
বলুর আমি কাকিমা।
কিন্তু শুধুই কি কাকিমা?
ও আমাকে কাকিমা বলেই ডাকত।
কিন্তু ওই ডাকের সঙ্গে ওর মন, ওর ভালোবাসা মিশে থাকত।
ঠাকুর বাড়িতে এমন করে আমাকে কেউ কখনও ডাকেনি।
আমি ওর চেয়ে বয়েসে চার বছরের ছোট, তবু ওর কাকিমা!
বলু যে আমার চেয়ে বয়েসে বড়, বোধবুদ্ধি লেখাপড়া অন্য সব দিক থেকে বড়, এই ব্যাপারটা আমার আর ওর সম্পর্কের মধ্যে ও নীরবে বুনে দিয়েছিল।
আমি ওর কাকিমা হয়েও ওকে শ্রদ্ধা করতুম। সেই শ্রদ্ধার সঙ্গে ক্রমশ মিশে গেল গভীর ভালোবাসা।
যে ভালোবাসা বুকের মধ্যে শিরায় টান ধরায়, সেইরকম।
আমার খুব ভয় করছে প্রশ্নটা করতে, তবু করছি।
এরই নাম কি প্রেম?
বলু যখন আমার হাত ধরে খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে চলত, মনে হত ওর শরীর থেকে কিছু একটা আমার শরীরে ঢুকে যাচ্ছে।
একদিন বলুকে বললুম সে কথা।
ও একটু হেসে কী সুন্দর করে তাকাল আমার দিকে। আমার চোখে চোখ রেখে জিগ্যেস করল, কী ঢুকে যাচ্ছে জানো?
আমি বললুম জানি, কিন্তু বলতে পারব না।
—কেন, পারবে না কেন?
–সব কথা বলা যায় না।
-কেন বলা যায় না?
—বললে পাপ হয়।
—পাপ হয়! মনের ভাব প্রকাশ করলে পাপ হয়? তুমি সেকেলে অশিক্ষিত মানুষের মতো কথা বলছ। তোমাকে এত পড়িয়ে এই লাভ হল?
—তোমার-আমার যে-সম্পর্ক, তাতে কথাটা বলা যায় না। এ-কথা ভাবাও অন্যায়। বলা তো দূরের কথা।
—তুমি এক নারী। আমি এক পুরুষ। এই আমাদের আদিম সম্পর্ক। সামাজিক সম্পর্কটা মানুষের মনগড়া। আমরা মানব-মানবী। সামাজিক পুতুল নই।
—তবু, কিছুতেই বলতে পারব না।
—তুমিই তো বললে, আমার শরীর থেকে কিছু একটা তোমার শরীরে ঢুকে যাচ্ছে। আমি জিগ্যেস করলাম, কী ঢুকে যাচ্ছে?
—কোনও নাম নেই তার। কিছু একটা ঢুকে যাচ্ছে। ব্যস, এইটুকু, বললাম আমি।
বলু বলল, নাম আছে।
আমি বললুম, সে নাম আমি জানিনে।
বলু বলল, আমি জানি।
–কী?
-ইচ্ছে।
আমার বিশ্বাস, বলুর প্রতি ঠাকুরবাড়ির অনেকেই অবিচার করেছেন।
আমার মেজোভাশুর সত্যেন্দ্রনাথ তো বলুকে দেখতে পারতেন না বলেই মনে হয়।
তবে বলুর প্রতি রবি ঠাকুরের অবিচারই আমাকে কষ্ট দিয়েছে সবচেয়ে বেশি।
বলু তার রবিকাকাকে বড্ড ভালোবাসত যে।
বলুর প্রতি ঠাকুরবাড়ির এই অবহেলা ও অবিচারের কথা না লিখলে অন্যায় করা হবে।
বলুর আদর্শ পুরুষ ছিলেন তার ঠাকুরদা দেবেন্দ্রনাথ।
বোলপুরে ভুবনডাঙার নির্জন বিশাল প্রান্তরে দেবেন্দ্রনাথই খুঁজে পান তাঁর সাধনার স্থান।
কী নাম জায়গাটার?
নাম ভুবনভাঙার মাঠ।
কোথায় গো সেই নির্জন ধু-ধু প্রান্তর?
সবাই জানে, বোলপুরে।
বোলপুর তো অনেক বড়। তার চেয়েও বড় বুঝি ভুবনভাঙার মাঠ!
ওই জায়গাটার আলাদা কোনও নাম নেই?
না তো!
দেবেন্দ্রনাথ এই নির্জন প্রান্তরে একটি বাড়ি করলেন। নিজে থাকবেন বলে?
না, না, কেউ যদি চান নির্জনে সাধনা করতে, এখানে থেকে তাঁর সেই ইচ্ছে পূরণ করতে পারেন।
দেবেন্দ্রনাথ নিজেও থাকতে লাগলেন ভুবনভাঙার মাঠের এই একলা বাড়িতে।
তিনি বাড়িটির একটি নামও রাখলেন—শান্তিনিকেতন! এই বাড়িটার নাম থেকে জায়গাটারও নাম হয়ে গেল শান্তিনিকেতন!
দেবেন্দ্রনাথ একটি ট্রাস্টডিড বা অছিপত্র বানালেন ওই শান্তিনিকেতন বাড়িটার ব্যাপারে। ওই অছিনামায় তিনি তাঁর একান্ত ইচ্ছেটি প্রকাশ করলেন। ইচ্ছেটা হল, ট্রাস্টিরা যেন শান্তিনিকেতনে একটি ‘ব্রহ্মবিদ্যালয়’ স্থাপন করেন।
কিন্তু দেবেন্দ্রনাথের ইচ্ছে, ইচ্ছে হয়েই থেকে গেল। তিনি চলে গেলেন। তাঁর ছেলেরা তাঁর ইচ্ছের ব্রহ্মবিদ্যালয়টি তৈরি করে উঠতে পাড়লেন না। হয়তো তাঁরা তেমনভাবে চাননি। হয়তো তাঁরা অন্যান্য কাজে বেশি ব্যস্ত ছিলেন।
বলু একদিন আমাকে বলল, আমি পিতামহের স্বপ্নটি পূর্ণ করতে চাই। কাজটা মহৎ কাজ। আমি করবই।
–কী কাজ গো? আমি একটু অবাক হয়েই জিগ্যেস করলুম।
সে বলল, কী কাজ মানে? তোমাকেও আমার সঙ্গে কাজ করতে হবে। মনে মনে তৈরি হও। খুব বড় দায়িত্ব কিন্তু।
–কী কাজ শুনি।
—তুমি হয়তো জানো না, পিতামহের ইচ্ছে ছিল শান্তিনিকেতনে একটি ব্রহ্মবিদ্যালয় স্থাপন করার। কাজটা তিনি করে যাবার সময় পাননি। আমিই উদ্যোগ নিয়ে কাজটা করব।
–ওরে বাবা, সে তো বিশাল ব্যাপার। আমি কী দায়িত্ব নেব! তা ছাড়া তোমার কাকার সংসার সামলাতেই তো আমি দিনরাত ব্যস্ত।
আমার কথা শুনে বলু কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। বোধহয় ওর মন খারাপ হয়ে গেল। ও আমাকে পাশে চেয়েছিল। ও যেমন আমার হাত ধরে হাঁটত তেমনি ব্রহ্মবিদ্যালয় স্থাপনের ব্যাপারেও আমার হাত ধরে এগোতে চেয়েছিল বলু। আমি ওকে নিরাশ করেছিলুম। আমার কোনও উপায় ছিল না। ওঁর অনুমতি না পেলে আমি বলুর পাশে দাঁড়াব কী করে?