আমি শুনেছি, নতুন বউঠান শেষ দিনে অনেক বড় একটি চিঠি লিখেছিলেন তাঁর প্রিয়তম রবিকে।
সে-চিঠি কোথায় গেল, কেউ জানে না।
নতুন বউঠান আর একটি ছোট চিঠি লিখেছিলেন তাঁর স্বামীকে।
শুনেছি, সেই চিঠির মধ্যে ছিল আর একটি চিঠি।
সেই ভালোবাসার চিঠিটা লিখেছিল কলকাতার এক বিখ্যাত নটী জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে।
নতুন বউঠান নাকি সেই চিঠিটা পেয়েছিলেন তাঁর স্বামীর জোব্বার পকেটে।
নতুন বউঠান তাঁর স্বামীকে শেষ দিনে যে চিঠিটি লেখেন তার মধ্যে নটীর চিঠিটি—সবটা গিয়ে পড়ে বাবামশায়ের হাতে।
বাবামশায়ের পক্ষে ক্ষমা করা সম্ভব হয়নি তাঁর পুত্রকে।
০৯. একজনের কথা
একজনের কথা সব শেষে না বললেই নয়।
কারণ আমি তাকে খুব ভালোবেসে ছিলুম।
আমি এই ভালোবাসার কথা কাউকে বলতে পারিনি।
আমি তো কোনও অন্যায় করিনি।
আমি যে খুব একা। আর আমার মনের ভিতর অনেক কষ্ট।
সে সব বুঝেছিল।
তা-ই তাকে ভালোবেসে ছিলুম।
তার মতো ভালো আমার শ্বশুরবাড়িতে আমাকে আর কেউ বাসেনি।
সে আমার থেকে মাত্র চার বছরের বড়।
আমি যখন বউ হয়ে ন’বছর ন’মাস বয়সে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে এলাম, বন্ধুর মতো এসে আমার হাত ধরল সে।
তখন তার বয়েস সবে তেরো পেরিয়েছে।
ঠিক যেমন রবি ঠাকুরের সঙ্গে দু-বছরের বড় নতুন বউঠানের বন্ধুত্ব, ভালোবাসা তৈরি হল, আমার সঙ্গে ঠিক তেমনই বন্ধুত্ব, ভালোবাসা তৈরি হল ঠাকুরবাড়ির এই ছেলেটির।
সে ছিল জন্মরুগ্ন।
আর তার বাপ ছিল বদ্ধ পাগল।
মা-ও যে তাকে খুব দেখত, তা-ও নয়।
ঠাকুরবাড়িতে তারা ছিল একটু একঘরে মতো।
সে ভালো করে হাঁটতে পারত না।
কত সময়ে আমাকে ধরে ধরে হাঁটত।
পা ঘসে ঘসে চলত বলে সে মেলামেশায় লজ্জা পেত। আমি তার মনের কষ্ট বুঝতুম।
এভাবেই ওর প্রতি আমার ভালোবাসায় স্নেহ-মায়া-মমতা-মাতৃত্ব সব মিলে মিশে ছিল।
ওকে না দেখলে ওর জন্যে খুব মনকেমন করত।
ও-ই আমাকে যত্ন করে লেখাপড়া শিখিয়ে ছিল।
ও খুব ভালো সংস্কৃত জানত।
সংস্কৃত কাব্য-নাটক আমাকে পড়ে শোনাত। আবার ব্যাখ্যা করে বুঝিয়েও দিত। ওই আমাকে কালিদাসের মেঘদূত আর কুমারসম্ভব পড়িয়েছিল। কুমারসম্ভব পড়ে খুব লজ্জা পেয়েছিলুম। শিব আর পার্বতীর কত আদরের কথা কী খোলাখুলি লিখেছেন কালিদাস!
আমি যে একটু-আধটু সংস্কৃত শিখতে পেরেছিলুম সেটা কিন্তু ওর জন্যে।
কী সুন্দর কবিতা লিখত সে!
যোলো বছর বয়েসে গান লিখেছে, সেই গান মাঘোৎসবে গাওয়া হয়েছে।
আমার বর তখন ‘বালক’ পত্রিকার সম্পাদক—সেই পত্রিকায় ওর লেখা বেরিয়েছে।
তারপর সে যখন আমাদের সঙ্গে শিলাইদহে থাকতে এল কিছুদিনের জন্যে—তখন সে তার খাতায় কত যত্নে টুকে রাখত ফকিরদের কাছে শোনা গান। গগন হরকরার গানও তার খাতায় ছিল!
এবার একটা অন্য কথা বলি–যা কেউ জানে না।
নতুন বউঠানের মতো আমিও একদিন আত্মহত্যা করতে চাইলেম।
সে সেদিন আমার সঙ্গে ছিল।
আমরা তখন একসঙ্গে শিলাইদহে। সে আর আমি। আমরা দুজনেই হয়তো একসঙ্গে মরতাম। কে জানে!
নতুন বউঠান একলা একলা বিষ খেয়ে মরতে পেরেছিলেন। আমরা হয়তো দুজনে একসঙ্গে শেষ হতে চেয়েছিলুম।
সেদিন শিলাইদহের ওপারে একটা চরের সামনে আমাদের বোট লাগানো আছে।
বিরাট চর। ধু-ধু করছে। কোথাও শেষ নেই। গ্রাম নেই, লোক নেই, কিচ্ছু নেই। শুধু চর।
সে বললে, এই চরের শেষটা একবার চলো দেখে আসি। সেখানে নাকি রূপকথার দেশ।
আমি বললুম, রূপকথার দেশে গেলে ফিরতে যদি ইচ্ছে নাই করে?
সে বললে, তবে ফিরব না।
আমি বললুম, তোমার পায়ের এই অবস্থায় হাঁটতে পারবে তো?
সে বললে, তুমি তো আছ।
আমরা বেরিয়ে পড়লুম।
হাঁটছি তো হাঁটছি।
কেমন যেন একটা নেশা ধরে গেল।
হঠাৎ সূর্য ডুবে গেল। আর ঝুপ করে নেমে এল অন্ধকার।
আমরা দিক হারালুম।
হাঁটতে-হাঁটতে এমন একটা জায়গায় পৌঁছোলুম যেখানে ছলাৎছলাৎ জলের শব্দ।
আমরা বোধহয় চরের শেষে বা ধারে চলে এসেছি। অন্ধকারে জল দেখা যাচ্ছে না।
সম্ভবত কয়েক ঘণ্টা হেঁটেছি। কোনও কথা বলিনি দুজনে। শুধু হাত ধরে হেঁটেছি।
আর একটু হাঁটলেই কালো পদ্মার বুক।
আমরা দুজনেই থেমে গেলুম। নতুন বউঠান পেরেছিলেন। আমরা পারলুম না।
ওইটুকু পথ হাঁটবার সাহস হল না আমাদের। আমি ভেবে ছিলুম ওর হাত ছাড়িয়ে একাই চলে যাই, পদ্মার কালো জলে ডুবে মরি। কিন্তু ওর হাত কিছুতেই ছাড়তে পারলুম না। ও আমার মনের ভাব বুঝে আমাকে জড়িয়ে ধরল। পদ্মার তীরে অন্ধকার রাত্তিরে আমি ওর বুকের মধ্যে নীরবে কেমন যেন জুড়িয়ে রইলাম। মরবার ইচ্ছেটা আস্তে আস্তে নিভে গেল।
হঠাৎ মনে হল, বোটে ফিরব কেমন করে?
তা-ও তো জানি না।
আমরা পথ হারিয়েছি।
পথটা অন্ধকারের মধ্যে আন্দাজ করে হাঁটতে লাগলুম।
এবার খুব ক্লান্ত।
মনে হচ্ছে এ-পথ শেষ হবে না। ভীষণ ভয় করছে।
হঠাৎ শুনতে পেলুম কিছু আর্তকণ্ঠের ডাকাডাকি। দেখতে পেলুম লণ্ঠনের আলো।
আমাদেরই খুঁজতে বেরিয়েছে বেশ কয়েকজনকে নিয়ে স্বয়ং রবি ঠাকুর।
শেষ পর্যন্ত বোটে ফিরলুম।
রবি ঠাকুর বললেন দুটি কথা—এক, স্ত্রী-স্বাধীনতার বিরুদ্ধে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলুম। দুই, তোমাদের এইভাবে একলা বেরোনো বন্ধ। তারপর আমার সঙ্গীটির দিকে শুধু একবার তাকালেন। সেই দৃষ্টিই যথেষ্ট।
আমি ভাবলুম অন্য কথা—সত্যিই যদি মরতে পারতুম। প্রতিদিনের সংসার থেকে দূরে। এই ধু-ধু নির্জনতার মধ্যে। নিঃশব্দ অন্ধকারে। বন্ধুর সঙ্গে।