একদিন আপনাদের রবি ঠাকুরকে হঠাৎ জিগ্যেস করেছিলেন, তোমার মুখে মারাঠি মেয়ে আন্না তড়খড়ের গল্প শুনেছি, বিলেতের কত মেয়েদের গল্প শুনেছি, ওদের দেখে আসার পর
আমাকে পছন্দ করলে কেন?
এতটুকু না দেরি করে ও বললে, আমার বিয়ের যেমন কোনও গল্প নেই, আমার পছন্দ অপছন্দেরও তেমনই কোনও ব্যাপার নেই। বউঠানরা যখন বড় বেশি পীড়াপীড়ি শুরু করলেন, আমি বললুম, তোমরা যা হয় করো, আমার কোনও মতামত নেই।
আমি বললুম, তুমি তো মেয়ে দেখতে গিয়েছিলে। আমাকে কী কারণে পছন্দ করলে?
ও কী বললে জানেন? বললে, দেখতে গিয়েছিলুম বুঝি?
আমার কখনও-কখনও মনে হয়, নিজের বিয়েটাকে অন্তত প্রথম প্রথম, ও নিজেই মেনে নিতে পারেনি।
ও তো ঠাট্টাই করেছিল আমার সঙ্গে ওর বিয়েটাকে।
তা না হলে কেউ নিজের বিয়ের নেমনতন্নের চিঠি ও যে ভাবে লিখেছিল, সেই ভাবে লেখে?
নেমনতন্ন চিঠিটার প্রথমেই মাইকেল মধুসূদনের লেখা এই লাইনটা ছিল—আশার ছলনে ভুলি কী ফল লভিনু হায়! তারপর এই চিঠি—নিজের হাতে লেখা—
আগামী রবিবার ২৪ অগ্রহায়ণ তারিখে শুভদিনে শুভলগ্নে আমার পরমাত্মীয় শ্রীমান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শুভবিবাহ হইবেক।
আপনি তদুপলক্ষে বৈকালে উক্ত দিবসে ৬নং জোড়াসাঁকোস্থ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভবনে উপস্থিত থাকিয়া বিবাহাদি সন্দর্শন করিয়া আমাকে এবং আত্মীয়বর্গকে বাধিত করিবেন। ইতি।
অনুগত শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
অনেকে এই চিঠিতে রবি ঠাকুরের কৌতুকভরা মনের পরিচয় পেয়েছেন। আমি চিঠিটা অনেক পরে হঠাৎ-ই দেখেছিলুম। এবং আমার বেশ খারাপ লেগেছিল।
তবে ভয় করেছিল—সত্যিই ভয়ে আমি কেঁদে ফেলেছিলুমবাসরঘরে। বাসরঘর আমাদের বাড়িতে হয়নি।
হয়েছিল জোড়াসাঁকোর বাড়িতে।
উনি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলে। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের নাতি।
কত বড় জমিদার!
সেই বাড়ির ছেলে কী করে যাবে তার কর্মচারীর মেয়েকে বিয়ে করতে তারই বাড়িতে?
কী করে সেই বাড়িতে হতে পারে তার বাসরঘর?
ও পরিষ্কার বলে দিলে, বিয়ে করতে আমি কোথাও যাব না।
কনেকে নিয়ে এসো জোড়াসাঁকোর বাড়িতে।
যা হওয়ার এখানেই হবে।
তাই হল। আমার বিয়েই হল সম্পূর্ণ এক অজানা অচেনা পরিবেশে।
এতবড় বাড়ি সেই আমি প্রথম দেখলুম।
এইরকম মানুষজনও কখনও আগে দেখিনি।
এঁদের কথাবার্তা, আদবকায়দা সব আলাদা।
বিশেষ করে মেয়েদের সাজপোশাক, কথা, পুরুষদের সঙ্গে মেলামেশা—এরকম তো আগে কখনও দেখিনি।
আমার যে কী লজ্জা করছিল, আর ভয় করছিল।
কোথায় গেল সব—আমার মা, আমার বাবা, আত্মীয়রা?
কোথাও তো তাদের দেখতেই পেলুম না।
তবে মনে আছে, এতটুকু ধুমধাম হয়নি আমার বিয়েতে। কোনও আনন্দ ছিল না বাড়িতে। যেন হঠাৎ আলো নিভে গেল। তার একটা কারণ অবিশ্যি আগেই বলেছি, আমার বড় ননদাই সারদাপ্রসাদ আমার বিয়ের দিনেই মারা যান।
আরও একটা কারণ, বরের নিজের মনে মনে কোনও আনন্দ ছিল না। এবং সবার মনের মধ্যে এই ভাবটি বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে, জোর করে আমার মতো একটি মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে বাড়িতে সবার প্রিয় রবির প্রতি নিদারুণ অবিচার করা হল।
এই অপরাধের ক্ষমা নেই, এ কথাটা মনে-মনে ঘুরছিল।
বাসরঘরে সম্ভবত চাপা অভিমান, রাগ, হতাশা থেকে আমার বর যে কাণ্ডটা করল, আমার বুক কাঁপছিল। পাশে আমার কেউ নিজের লোক, মানে বাপের বাড়ির কেউ ছিল না, তা-ই আরও ভয় পেয়ে গেলুম।
নিজেরই বাড়িতে পশ্চিমের বারান্দা ঘুরে বর এল আমাকে বিয়ে করতে। এসে দাঁড়াল পিঁড়ির উপর।
এরপর মনে পড়ছে বাসরঘরের কথা। ভাঁড়-কুলো খেলার সময় এল।
ভাঁড়ের চালগুলি ঢালাই-ভরাই করা হল ভাঁড়খেলা।
আমি একগলা ঘোমটার মধ্যে দিয়ে দেখছি আমার বর কেমন ভাঁড় খেলে।
ও করল কী, ভাঁড়গুলো ধরে ধরে সব উপুড় করে দিতে লাগল।
ওর ছোট কাকিমা ত্রিপুরাসুন্দরী, যাঁর গল্প ইতিমধ্যে বলেছি, উনি তো চিৎকার করে উঠলেন —ও কী করিস রবি? ওই বুঝি তোর ভাঁড়খেলা? ভাঁড়গুলো সব উলটেপালটে দিচ্ছিস কেন?
দেখলাম, ঠিক সেই সময়ে ঘরে এসে দাঁড়ালেন যিনি, পরে জেনেছিলুম তিনিই নতুন বউঠান!
খুব অসুস্থ লাগছিল তাঁকে।
সবাই তাকিয়ে তাঁর দিকে।
তাঁর চোখ দিয়ে মনে হল আগুন ঝরছে। আর ঠোঁটে হাসি।
আমার বর ছোট কাকিমা ত্রিপুরাসুন্দরীকে বললে, জানো না কাকিমা, আজ আমার জীবনের সব কিছুই তো উলটপালট হয়ে গেল! কাজেই আমি ভাঁড়গুলোও উলটে দিচ্ছি। আমার বর তাঁর ছোটকাকিমাকে কথাগুলো বললেন বটে, উনি কিন্তু সারাক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন নতুন বউঠানের চোখের দিকে! ওর সেই কথা আজও শুনতে পাই।
আমার বরের মুখে একথা শুনেই নতুন বউঠান মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
ছোট কাকিমা খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, রবি, তুই একটা বরং গান কর। তোর মতো গাইয়ে থাকতে তোর বাসরে আর কে গান গাইবে?
কাকিমার মুখের কথা খসতে না খসতে কর্তাটি আমার মনে হল আমাকে বেশ ঠাট্টা করেই গান শুরু করে দিল—
আ মরি লাবণ্যময়ী
কে ও স্থিরসৌদামিনী,
পূর্ণিমা-জোছনা দিয়ে
মার্জিত বদনখানি!
নেহারিয়া রূপ হায়,
আঁখি না ফিরিতে চায়,
অপ্সরা কি বিদ্যাধরী
কে রূপসী নাহি জানি।
প্রথম রাত্তিরেই আপনাদের রবি ঠাকুর আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন উনি আমাকে কী চোখে দেখলেন—বাকি জীবন কী চোখে দেখবেন।