এইবার সেই প্রশ্নের উত্তরের কাছাকাছি আসছি রবি ঠাকুর, তুমি আমাকে বিয়ে করেছিলে কেন? কেন রবি ঠাকুর, কেন? সেই ‘কেন’-র উত্তর আমি নিজেই খুঁজেছি সারা জীবন। এবার হয়তো উত্তরটির কাছাকাছি আসছি ক্রমশ।
ঠাকুরবাড়ির বধূদের চিরাচরিত ‘আকর’ যশোর। বউঠাকুরানিরা তাঁদের প্রিয় রবির বউ খুঁজতে সেখানেই এলেন। তার মানে, কনে খুঁজতে এলেন, জ্ঞানদানন্দিনীদেবী এবং কাদম্বরীদেবী, দু’জনেই। সঙ্গে এসেছিল ইন্দিরা, মানে মেজোজার মেয়ে। আর কে এসেছিলেন জানেন—স্বয়ং রবি ঠাকুর।
যদিও উনি বলেছেন, উনি আসেননি। কিন্তু উনি না এসে পারেননি।
কারণ নতুন বউঠান যে এসেছিলেন। কে
ন এসেছিলেন নতুন বউঠান?
অনেক পরে বুঝেছি, তাঁর আত্মহত্যারও অনেক পরে, যখন একটু বয়েস হল আমার, তখন বুঝেছি তাঁর ভালোবাসার মানুষটির বউ খুঁজতে তাঁকে জোর করে নিয়ে আসা হয়েছিল—ইচ্ছে করে তাঁকে এই মানসিক শাস্তি দেয়া হয়েছিল। এই হল ঠাকুরবাড়ির মেয়েমহলের নিষ্ঠুরতা। পরে যখন বুঝতে পেরেছি, আমার খুব কষ্ট হয়েছে নতুন বউঠানের জন্যে। সেই মানসিক কষ্ট যাতে তাঁকে একা না পেতে হয়, জ্ঞানদানন্দিনীর চাপ তাঁকে না একা সহ্য করতে হয়, সেইজন্যেই নতুন বউঠানের সঙ্গে তাঁর প্রিয়তম মানুষটিও এসেছিল—আমাকে দেখে পছন্দ করতে নয়, নতুন বউঠানকে আগলাতে, তাঁর পাশে থাকতে।
এবার প্রশ্ন হল, যশোরে এত মেয়ে থাকতে আমাকে পছন্দ হল কেন?
যশোরে এত মেয়ে তো কী হয়েছে, সবাই তো আর পিরালি-ব্রাহ্মণ ঠাকুরবাড়িতে মেয়ে দেবে না। পিরালিরা মুসলমানের জলছোঁয়া ব্রাহ্মণ। তায় আবার ব্রাহ্ম। হিন্দুদের মতো নারায়ণ-সাক্ষী করে বিয়ে করে না। তা ছাড়া সে বছর বোধহয় যশোরে সুন্দরী মেয়েদের আকাল পড়েছিল। আমাকে পছন্দ হওয়ার কারণ বউঠাকরুণরা অনেক চেষ্টা করেও রবি ঠাকুরের জন্যে মনের মতো কনে খুঁজে পাননি।
তবে আরও একটু কারণ আছে। একটু গোপন কারণ এবং আরও জরুরি কারণ।
আমার বাপ জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির এক সামান্য কর্মচারী বেণী রায়। সুতরাং এ-বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেল যে, আমি ঠাকুরবাড়ির একান্ত বাধ্য বউ হব, সারা জীবন মুখে রা-টি কাটব না। সেই সাহসই হবে না আমার।
নতুন বউঠানও তো তাই। বাজার সরকারের মেয়ে—তিনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বউ!
আমি ঠাকুরবাড়ির আর এক কাজের লোকের মেয়ে—রবি ঠাকুরের বউ!
আর জ্ঞানদানন্দিনী, আমার মেজোজা? তাঁর বাবা অভয়চরণের তো এক বিরাট গল্প। সে গল্প তাঁর মুখেই শুনেছি। তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে এক ধনী পিরালি-ব্রাহ্মণের বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছিলেন। এবং তাঁরই মেয়ে নিস্তারিণীকে তিনি বিয়ে করে ঘরজামাই হন। জ্ঞানদানন্দিনী বউ হয়ে ঠাকুরবাড়িতে এলেন তাঁর দুধেদাঁত পড়ার আগে। একদিন আমাকে গপ্পো করে বললেন, দুধেদাঁত পড়লে ইঁদুরের গর্ত খুঁজে সেখানে দাঁতটি দিয়ে বলতে হয়, ইঁদুর, পড়া দাঁত তুমি নাও, তোমার দাঁত আমায় দাও। বিয়ের পরে আমার যখন দুধেদাঁত পড়ল তখন কলকাতার পাকা ইটচুনের বাড়িতে কোথায় খুঁজব ইঁদুরের গর্ত? সে এক সমস্যা হয়েছিল। এই জ্ঞানদানন্দিনী লেখাপড়া শিখে একা বিলেত গিয়েছিলেন। তারপর আবার গভর্নর লরেন্সের পার্টিতেও একা গিয়েছিলেন! তাঁর কাছে আমরা তো কোন ছার! আমার তো মনে হয়, আমার মেজোজা চেয়েছিলেন, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথের বউ যেন আমরাই হই, যাদের সামাজিক পরিচয় অনেক নীচের। এখানে স্বীকার করছি, একটা ব্যাপার আমার খুব ভালোলাগে—এই যে ঠাকুরবাড়ির মঞ্চ আলো করে হঠাৎ যেন উড়ে এসে জুড়ে বসেছিলেন ওর নতুন বউঠান কাদম্বরীদেবী আর জ্ঞানদানন্দিনীকে কিছুদিনের জন্যে যে ছায়ায় চলে যেতে হয়েছিল, ওঁর লাঠি ঘোরানো একদম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, সেই ব্যাপারটা আমার বেশ মনে ধরেছে। নতুন বউঠানকে সারা জীবন ঠাকুরবাড়ির মহিলামহল নানাভাবে মানসিক কষ্ট দিয়েছে। আমি যখন ভাবি, আপনাদের রবি ঠাকুর অত অল্প বয়সে তাঁর নতুন বউঠানের পাশে দাঁড়িয়ে সেই অত্যাচারের প্রতিশোধ নেওয়ার হয়তো চেষ্টা করেছিলেন, তখন আমার মধ্যে কষ্টের, বেদনার যে আগুন জ্বলছে তার মধ্যে কোথাও যেন একটু অহংকারও মিশে যায়। আমার বরকে আমার ভালোবাসার মতো একজন মানুষ বলে মনে হয়। ওর কবিতা, গান, কতরকমের লেখা আমি অত বুঝিনে। কিন্তু এইটুকু বুঝি, ও নতুন বউঠানকে এত ভালোবেসেছিল, আজও বাসে, সেই মেয়ে এ-বাড়িতে এত একা একা কষ্ট পেয়েছিল বলে। তার বাপের বাড়ির জোর ছিল না বলেই তো এত কষ্ট তাঁকে পেতে হল। আমারও তো তা-ই।
আমার সঙ্গে রবি ঠাকুরের বিয়ের ঠিক হল আর যশোরেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন নতুন বউঠান।
তাঁর প্রিয়তম মানুষটির বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, এ-বিয়ে আটকাবার আর কোনও উপায় নেই, রবি আর তাঁর থাকবে না—এই মানসিক যন্ত্রণা তিনি সহ্য করতে পারেননি। এবং এই যে তিনি অসুস্থ হলেন, আমার বিয়ের পরে যে ক’টি মাস তিনি বেঁচে ছিলেন, তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে বেশ অসুস্থই ছিলেন। আমি যখন তাঁকে দূর থেকেই দেখতুম, কেমন যেন মানুষ বলে মনেই হত না তাঁকে। মনে হত তিনি ছায়া। খুব দুঃখী ছায়া। তবে ভারি সুন্দর দেখতে। ঠাকুরবাড়িতে সবচেয়ে সুন্দরী ওই ছায়ার মতো মেয়ে। শুনেছিলুম, ওঁর বয়স নাকি পঁচিশ। আমার মনে হত অনেক কম। কী পাতলা হালকা গড়ন। তাই হয়তো বয়স অত কম মনে হত। রং বেশ চাপা, ছিপছিপে, আর চোখের চাউনিতে কী যেন ছিল, ঠিক বলতে পারব না—অন্য কোনও মেয়ের অমন চাউনি দেখিনি–।