মরিয়া না হলে সবাই দেখবে পড়বে জানবে জেনেও সে লিখল কী করে এইভাবে–
স্নেহের অরুণাললাকে
খুলিয়া হৃদয় প্রাণ।
এপারে দাঁড়াবে দেবি,
গাহিনু যে শেষ গান
তোমারি মনের ছায়
সে গান আশ্রয় চায়—
একটি নয়নজল তাহারে
করিয়ো দান।
আজিকে বিদায় তবে,
আবার কি দেখা হবে—
পাইয়া স্নেহের আলো
হৃদয় গাহিবে গান?
উপর-উপর একটা মোড়ক আছে বটে। স্নেহের মোড়ক। কিন্তু সে তো শাক দিয়ে মাছ ঢাকা। সবাই যা বোঝার তাই বুঝেছিল নিশ্চয়।
ও কিন্তু বিলেত গেল না।
গেল না মানে যেতে পারল না।
নতুন বউঠানের জন্যে মনকেমন সামলাতে পারেনি।
তাছাড়া ওর মনে ভয় ছিল, নতুন বউঠান ওকে ছাড়া বাঁচতে পারবে না, আবার আত্মহত্যা করার চেষ্টা করবে। তাই জাহাজ মাদ্রাজে পৌঁছতে ও জাহাজ থেকে পালিয়ে গেলই বলা যায়।
একেবারে সোজা চন্দননগরে। সেখানেই নতুন বউঠানকে নিয়ে উঠেছিলেন তাঁর স্বামী। আমার বর সেখানে হঠাৎ গিয়ে হাজির।
নতুন বউঠান আশাই করেননি তাঁর রবি জাহাজ থেকে পালিয়ে তাঁর কাছে চলে আসবে। সেই পুনর্মিলনের গল্প আমি আমার বরের মুখেই শুনেছি। যতটা মনে আছে ওর ভাষাতেই লিখছি— আমি তো ফিরে এলেম মাদ্রাজ থেকে। সেই ফিরে আসাটা বিফলে গেল না ছোটবউ। নতুন বউঠান তখন জ্যোতিদাদার সঙ্গে তেলেনিপাড়ায় বাঁড়ুজ্যেদের বাগানবাড়িতে। গিয়ে দেখি জ্যোতিদাদা রয়েছেন তাঁর নিজস্ব জগতে। আর নতুন বউঠান ভারি নিঃসঙ্গ। আমাকে ফিরে পেয়ে সে যে কী খুশি হয়েছিল! আবার গানে কবিতায় ভরিয়ে দিলেম তাকে। বুঝলে ছুটি, গঙ্গা সাঁতরে তখন এপার-ওপার হতেন। নতুন বউঠান দেখে আতঙ্কে শিউরে উঠত। আর সেই মেয়ে যে আমার জন্যে এতটাই উদ্বিগ্ন তা দেখতে আমার ভালোলাগত। আমি সাঁতার কাটতে কাটতে এতই দূরে চলে যেতাম যে সে আর আমাকে দেখতে পেত না। তখন প্রায় কান্নাকাটি শুরু করে দিত আমি ডুবে গেছি ভেবে। এখন ভাবি নতুন বউঠানকে এতটা কষ্ট না দিলেই পারতাম—তার তো মনের কষ্টের অভাব ছিল না।
তারপর একদিন বাঁড়ুজ্যেদের বাগানবাড়ি থেকে চন্দননগরেই আরও একটা রোম্যান্টিক ঠিকানায় চলে এলাম আমরা। মোরান সাহেবের বাগানবাড়ি—এ-বাড়িটা আরও সুন্দর। একেবারে গঙ্গার উপরেই। আর তখন ভরা বর্ষা। একদিন দুপুরবেলা খুব বৃষ্টি এল। যাকে বলে বৃষ্টিপাত মুখরিত জলধারাচ্ছন্ন মধ্যাহ্ন। সেই দুপুরবেলাটা নতুন বউঠানের সঙ্গে আমি খ্যাপার মতো কাটিয়েছিলাম। সেই খ্যাপামিটা ছিল আমাদের দু’জনের। বিদ্যাপতির ‘ভরা বাদর মাহ ভাদর’ পদটিকে মনের মতো সুর বসিয়ে গাইতে গাইতে আমরা দুজনে বৃষ্টিতে ভিজেছিলুম— কোনও বাধা ছিল না সেদিন আমাদের মধ্যে। আবার হয়তো কোনও-কোনওদিন সূর্যাস্তের সময় আমরা দুজনে নৌকো করে বেরিয়ে পড়তাম—তখন পশ্চিম আকাশে সূর্য অস্ত যাচ্ছে, তার আলো এসে পড়েছে নতুন বউঠানের চোখে, চুলে। কী সুন্দর যে দেখাচ্ছে তাকে! সেই মায়া কাটতে না কাটতে তাকে আবার নতুন রূপে পেতুম, যখন সূর্যাস্তের পর পূর্ববনান্ত থেকে চাঁদ উঠত। তারপর আমরা বাগানের ঘাটে ফিরে নদীতীরের ছাদটার উপরে বিছানা করে চুপচাপ। তীরের বনরেখা অন্ধকারে নিবিড় হয়ে আসত। সেই যে দু’জনে মিলে কল্পনার রাজ্যে বিচরণ, সেই মৃদু গম্ভীর স্বরে গভীর আলোচনা, মনের দেয়ানেয়া, সেই সন্ধেবেলার ছায়া, কোনও-কোনওদিন শ্রাবণের বর্ষণ আর বিদ্যাপতির গান—ছোটবউ, তারা সব চলে গেছে। কিন্তু তবু তারা যায়নি। আমার গানে, আমার কবিতায় তাদের ইতিহাস লেখা থাকল। মনে পড়ছে, একদিন নতুন বউঠানকে বলেছিলুম, আমার লেখার মধ্যে আরও একটি লেখা লুকিয়ে থাকল। এক লেখা আর সকলে পড়বে। আর সেই লুকিয়ে থাকা লেখা তুমি আমি পড়ব। কিন্তু তা-ই কি হয় রবি ঠাকুর? সবাই কি এত বোকা? তোমার লেখার মধ্যে লুকিয়ে থাকা লেখার মানে যে সবাই বুঝে গেল একদিন। তোমার লুকিয়ে থাকা লেখাই যে ডেকে আনল সর্বনাশ! আমাদের বিয়ের মাস সাতেক আগেই হবে, ‘ভারতী’ পত্রিকাতে তুমি লিখেছিলে একটা লেখা—সেই লেখার আমি খোঁজ পেয়ে পড়েছি। তুমি কেন লিখতে গেলে এই লেখাটা? আবেগ সামলাতে পারোনি? ভেবেছিলে কেউ বুঝবে না? বা বুঝেও চুপ করে থাকবে? তুমি লিখেছিলে হুবহু এই কথা—
সেই জানলার ধারটি মনে পড়ে, সেই বাগানের গাছগুলি মনে পড়ে, সেই অশ্রুজলে সিক্ত আমার প্রাণের ভাবগুলিকে মনে পড়ে। আর একজন যে আমার পাশে দাঁড়াইয়া ছিল, তাহাকে
মনে পড়ে, সে যে আমার খাতায় আমার কবিতার পার্শ্বে হিজিবিজি কাটিয়া দিয়াছিল, সেইটে দেখিয়া আমার চোখে জল আসে। সেই তো যথার্থ কবিতা লিখিয়া ছিল। তাহার সেই অর্থপূর্ণ হিজিবিজি ছাপা হইল না, আর আমার রচিত গোটাকতক অর্থহীন হিজিবিজি ছাপা হইয়া গেল।
এই লেখা বেরোবার পরে বাবামশায় আর বসে থাকেননি। তখন তিনি মুসৌরিতে। সেখান থেকে তিনি আপনাদের রবি ঠাকুরকে চিঠি লিখে আজ্ঞা করেন, অবিলম্বে তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্যে। আপনাদের রবি ঠাকুর বলেছেন বটে, তাঁর বিয়ের কোনও গল্প নেই, কিন্তু গল্প একটা আছে বইকি। সেই গল্পের শুরু ‘ভারতী’ পত্রিকায় এই লেখাটি থেকে। তারপর বাবামশায়ের চিঠি—অবিলম্বে আমার সঙ্গে দেখা করো এবং তাঁর আদেশ, যত শীঘ্র সম্ভব, বিয়ে করো। এরপরেই বউদিদিদের আগ্রহ রবির বিয়ের জন্যে বিশেষ করে মেজোজার ইচ্ছে বিয়েটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হোক।