কেমন যেন রহস্যের গন্ধ পেয়েছিলুম আমি। কৌতূহল থেকে প্রশ্নটা করে ফেলেছিলুম।
ও সম্ভবত একটু বিরক্তই হল। বললে, সব কথা সবাইকে জানতে নেই।
আমি বললুম, আমাকেও জানতে নেই?
ও বললে, জানলেও বুঝবে না। তবু, জানতে যখন চাইছই, শোনো। ’হে’ হল হেমাঙ্গিনী।
—হেমাঙ্গিনী! সে কে?
—হেকেটি আর হেমাঙ্গিনী সব একাকার হয়ে আছে।।
–বুঝতে পারছিনে, একটু খোলসা করে বলো না বাপু।
—হেকেটি এক রহস্যময়ী দেবী। আর হেমাঙ্গিনী হল নতুন দাদার লেখা অলীকবাবু নাটকের নায়িকা। দু’টি চরিত্রের মধ্যেই মিশে আছে নতুন বউঠান।
এর বেশি কিছু সেদিন আমাকেও বলেনি। বাকি গল্পটুকুও আমি একটু একটু করে জোগাড় করে গেঁথেছি। আগে বলেওছি সেকথা। কিন্তু যা বলিনি, তা এবার বলতে চলেছি।
লিখতে খুব খারাপ লাগছে। তবু লিখছি।
কেন লিখছি, জানি না। আমার জীবদ্দশায় এ-লেখার কথা কেউ জানবে না।
আমার মৃত্যুর পরে যদি কোনওদিন কেউ আবিষ্কার করে এই লেখা…তবু কোনওদিন ছাপা হবে, এ-আশা আমি করি না। ঠাকুরবাড়ির যা রীতি, সেই অনুসারে এই লেখা, এই অপ্রিয় সত্য, জ্বলে-পুড়ে শেষ হবে।
আমার স্বামী বিলেত থেকে ফেরবার পরেই নতুন বউঠানের মধ্যে যে প্রাণের জোয়ার এল, যেভাবে দু’জনের মেলামেশা ঘনিষ্ঠতা শুরু হল, সেটা ঠাকুরবাড়ির অনেকেরই চোখে পড়ল।
বিশেষ চোখ টাটাল আমার মেজোজা জ্ঞানদানন্দিনীর। তিনি কিংবা মেজোভাশুর, কেউ একজন কথাটা বাবামশায়ের কানে তুলে দেন বলে আমার ধারণা।
বাবামশায় তো কোনওরকম উত্তেজনা বা আবেগ দেখান না। উনি চাইলেন, রবিকে যেন তখুনি আবার বিলেত পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ওর আবার বিলেত যাওয়ার সব ঠিকঠাক হয়ে গেল।
কথাটা নতুন বউঠানের কাছে পৌঁছোতে দেরি হল না।
রবি আবার তাঁকে ছেড়ে চলে যাবে?
আবার সেই একা জীবনের যন্ত্রণা? আবার ঠাকুরবাড়ির মেয়েমহলের সেই অত্যাচার?
তাঁর প্রাণের দেওরটিই তো শুধু তাঁর বেদনার কথা বোঝে এতবড় বাড়িতে।
তাঁর মনের কথা বলার আর তো কেউ নেই সেই ছেলেবেলা থেকে। দেড়বছর পরে ফিরে আসার পর রবিই হয়ে উঠেছে তাঁর একমাত্র অবলম্বন।
রবিকে ছেড়ে থাকা এখন আর তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।
নতুন বউঠান আত্মহত্যা করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তাঁর সেই প্রথম চেষ্টা ব্যর্থ হল।
তাঁর ব্যর্থ আত্মহত্যার গল্প নানাভাবে রটতে লাগল। এরকম একটা মুখরোচক গল্পে ঠাকুরবাড়ির মেয়েমহল যে কত রকমের রং চড়াল। বাবামশায় যে সে গল্প জানতেন, তাতেও কোনও সন্দেহ নেই।
আমি নিশ্চিত, নতুন বউঠান আত্মহত্যা করার চেষ্টা করায় তাঁর সঙ্গে আমার স্বামীর সম্পর্ক নিয়ে আরও বেশি কানাঘুষো শুরু হল। নতুন বউঠান আর জোড়াসাঁকোর বাড়িতে থাকতে পারলেন না। কোথায় যাবেন তিনি?
তাঁর তো কোনও বাপের বাড়িও নেই।
স্বাভাবিকভাবে জ্ঞানদানন্দিনীর চাপ এল জ্যোতিরিন্দ্রনাথের উপর—নতুন ঠাকুরপো, কোথাও একটু কিছুদিনের জন্যে বউকে নিয়ে ঘুরে এসো। এ বাড়িতে এখন তোমাদের বেশ কিছুদিন না থাকাই উচিত। ব্যাপারটা একটু থিতিয়ে যাক। তখন না হয় ফিরে এসো। আমার তো মনে হয় বাবামশায়ই পিছন থেকে আমার মেজোজাকে বলেছিলেন, নতুন বউঠানকে তাঁর স্বামীর সঙ্গে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিতে। তিনি চাইছিলেন, নতুন বউঠানের সঙ্গে তাঁর স্বামীর সম্পর্কটা আরও অনেক আঁটসাঁট হোক।
ওকে যে আবার বিলেতে ফেরত যেতে হবে, সেটা আমার বর বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিল। বুঝতে পেরেছিল, নতুন বউঠানের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভেঙে দেওয়া হবেই—আজ না হয় কাল।
ব্যারিস্টার হতেই হবে, যাও বিলেত যাও, আইন পড়ো, শুধু গান-কবিতা লিখে বাড়িতে বসে থাকলে হবে না রবি ঠাকুরকে তো প্রায় হুকুম করা হল। আদেশ করলেন তার মেজোদাদা ও মেজো বউঠাকরুণ।
ওর মনেও তো কষ্ট কম হয়নি নতুন বউঠানকে ছেড়ে আবার চলে যেতে হবে ভেবে। নতুন বউঠান তাঁর রবিকে ছেড়ে থাকতে পারবেন না, তা তিনি যেখানেই যান তাঁর স্বামীর সঙ্গে, একথাও প্রিয়তম দেওরটি অনুভব করেছিল।
আর সেই কথাটাই তো অকপটে না লিখে পারল না ‘ভগ্নহৃদয়’-এর উৎসর্গে—সে লিখেছে, আমি যে কতবার পড়েছি এই লাইনগুলি, কষ্ট পেতে ভালো লেগেছে, তাই পড়েছি–
আজ সাগরের তীরে দাঁড়ায়ে
তোমার কাছে;
পরপারে মেঘাচ্ছন্ন
অন্ধকার দেশ আছে।
দিবস ফুরায়ে যবে সে দেশে
যাইতে হবে,
এপারে ফেলিয়া যাব
আমার তপন শশী—
ফুরাইবে গীত গান,
অবসাদে ম্রিয়মান,
সুখ শান্তি অবসান—
কাঁদিব আঁধারে বসি।
আমি ভাবতে চেষ্টা করছি তখন ঠিক আমার বরের মনের অবস্থা কেমন?
যে সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসে তার নতুন বউঠানকে। তার নতুন বউঠানও খুব ভালোবাসেন তাকে। তাঁদের জীবনের প্রথম প্রেম বলতে কিন্তু এই ভালোবাসাটাই।
জোর করে ঘটানো হচ্ছে তাঁদের বিচ্ছেদ। এছাড়া উপায় বা কী? এই অসামাজিক সম্পর্ক কোন সর্বনাশের দিকে নিয়ে যাবে দু’জনকে? হয়তো সমগ্র পরিবারকেই? ।
নতুন বউঠানকে ছেড়ে ও যে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে, কেমন তার মনের অবস্থা সেই মুহূর্তে? আমার বর কিন্তু কিছু লুকোয়নি। তার মনে ভয়, তার সঙ্গে তার নতুন বউঠানের আর কোনওদিন দেখা হবে না। তাকে ছাড়া তার বউঠান বাঁচবে না—এ-বিষয়ে সে নিশ্চিত। এর পরে, সে-ও হয়তো আর লিখবে না। লিখলেও সেই লেখার জন্যে থাকবে না তার নতুন বউঠানের হৃদয়ের ছায়া, তার প্রেমের আশ্রয়। সে শুধু চাইছে একটুখানি কান্না—তার নতুন বউঠানের চোখের জল। এই লেখা যখন ছেপে বেরোল সবাই তো বুঝল। আমার বরের কি একটুও ভয় করেনি! আমার বর কী মরিয়া হয়ে ভালোবেসেছিল নতুন বউঠানকে!