ওর কবিতার খাতায় আমার চোখের জল পড়ল।
ভাগ্যিস কোনও অক্ষরের উপর পড়েনি।
আমি মুছে দিলুম।
ও বুঝতেও পারবে না।
০৭. নতুন বউঠান আর আমার বর
এই যে নতুন বউঠান আর আমার বর, দু’জনে মিলে বাড়ির ছাদে তৈরি করল ওদের নন্দনকানন, ওটার একটা ভিতরের রূপ আছে।
ওটা শুধুমাত্র একটা বাগান নয়।
ওটা ওদের দুজনের সম্পর্কের বাগান। ওই বাগানটার মধ্যে ওদের লুকোনো প্রেমকে ওরা ঘোষণা করল।
ভালোবাসা কি কখনও লুকিয়ে রাখা যায়? যায় না। এ তো আমার বরের কথা। গোপন কথা নাকি চোখের দৃষ্টিতে ফুটে ওঠে।
একদিন আমাকেও বলেছিল, আমার অনেক কবিতা আর গানের মধ্যে আমি জানিয়ে দিয়েছি আমার গোপন ভালোবাসার কথা। এই গোপন কখা তো গোপন রাখা যায় না ছোটবউ। যে কথা বলছিলেম, ওই নন্দনকাননের মধ্যেই দেয়ানেয়া, ওদের সম্পর্ক আরও গাঢ় হল।
সন্ধে হলেই নতুন বউঠান গা-ধুয়ে চুল বেঁধে প্রিয়তম ঠাকুরপোটির সঙ্গে ছাদে যেতেন। নন্দনকাননে পাতা হত মাদুর আর তাকিয়া।
নতুন বউঠান রুপোর রেকাবিতে ভিজে রুমালে বেলফুলের গোড়ে মালা ঢাকা দিয়ে রাখতেন।
আর নিজের ঠোঁট রাঙিয়ে তোলার জন্যে বাটিতে রাখতেন ছাঁচি পান।
আমার স্বামীর মুখেই শোনা—নতুন বউঠানের জন্যে, শুধু তাঁকে শোনাব বলেই নতুন-নতুন গান লিখতুম আমি। আমার মধ্যে যেন ভালোবাসার গানের প্লাবন এসেছিল। নন্দনকাননে হু-হু করে বইত দক্ষিণে বাতাস। নতুন বউঠাকরুণ তার আঁচল আর চুল সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ত। আর দক্ষিণে বাতাসের কাছে পরাজয় স্বীকার করে তার সেই হাসি মনে পড়ে আমার কী যে সুন্দর দেখাত তাকে। ওর হাসি যেন আকাশের গায়ে ফুটিয়ে তুলত তারা। সে বলত, কী গো ঠাকুরপো, আজ আমায় নতুন গান শোনাবে না? আমিও দিলেম নতুন বউঠানকে আমার নতুন গানটি শুনিয়ে—ধরলেম বেহাগে—
মধুর মিলন। হাসিতে মিলেছে হাসি, নয়নে নয়ন।
মরমর মৃদু বাণী মরমর মরমে, কপোলে মিলায় হাসি সুমধুর শরমে—নয়নে স্বপন।।
তারাগুলি চেয়ে আছে, কুসুম গাছে গাছে—
বাতাস চুপি চুপি ফিরিছে কাছে কাছে। মা
লাগুলি গেঁথে নিয়ে, আড়ালে লুকাইয়ে
সখীরা নেহারিছে দোঁহার আনন—
হেসে আকুল হল বকুলকানন।
গানটা পুরোটাই গাইলেন আপনাদের রবি ঠাকুর। তারপর নিজেকেই যেন ঠাট্টা করে গেয়ে উঠলেন—আ মরি মরি।
আমি তো অবাক। কতদিন আগের লেখা গান, এখনও মনে আছে! এই গানটা তো কোনওদিন কাউকে গাইতে শুনিনি।
কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে ও বললে, বুঝলে ছোটবউ, তখন গান বললেই গান আসত। সুরও আসত সঙ্গে। একুশ-বাইশ বছরের লেখা তো বেশ কাঁচা। কিন্তু গানের মধ্যে সেই নন্দনকাননের পরিবেশ আর নতুন বউঠানের হাসিটি ধরা আছে। ধরা আছে তার চোখের মায়া আর লজ্জার সুমধুর রূপটি। একেবারে ক্যামেরার মতো। ছবিটার মধ্যে আমিও আছি-ওই যে, হাসিতে মিলছে হাসি, নয়নে নয়ন। আমার বুকের মধ্যে সমস্ত তোলপাড়ের গলা টিপে আমি জিগ্যেস করলুম, এমন সুন্দর গান শুনে নতুন বউঠান কী বললেন?
বিশেষ কিছু বলল না। এক পাগলামি করে বসল। গড়ে মালাটা ভিজে রুমালের ভিতর থেকে বের করে দিলে আমার গলায় পরিয়ে। আর হেসে বললে, আজ স্বীকার করছি ঠাকুরপো, তুমি বিহারীলালের চেয়ে অনেক বড় কবি।
আমি বললুম, নতুন বউঠান যে শেষ পর্যন্ত তোমাকে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন যে বিহারীলাল চক্রবর্তীর থেকে তুমি বড় কবি—এ তো তোমার খুব একটা বড় জয়। তুমিও নিশ্চয় আনন্দে তাঁকে কিছু একটা দিয়েছিলে।
ও বেশ কিছুক্ষণ আমার প্রশ্নের উত্তর দিল না। মনে হল, ও কিছু একটা, গভীর কিছু ভাবছে। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম। ও হঠাৎ আমাকে ডেকে বলল, ওই মালাটা আমি আমার কাছে অনেকদিন পর্যন্ত রেখে দিয়েছিলেম। ফুলগুলি শুকিয়ে সব কালো হয়ে গিয়েছিল। তবু আমার কাছে ওই মালাটা বেঁচে ছিল—এতটুকু নষ্ট হয়নি। কত বসন্তে, কত বর্ষায়, কত শরতে আমি যে নতুন বউঠানের কত কাছে ছিলেম, কত প্রভাতে দুপুরে সন্ধ্যায় সে আমাকে কতভাবে দেখেছে, কত ভালোবেসেছে আমাকে সতেরো বছর ধরে, কত সুখদুঃখের মধ্যে দিয়ে আমরা দু’জনে একসঙ্গে গেছি, সতেরো বছর ধরে আমার জীবন যে তার সব ডাকে সাড়া দিত—এই সমস্ত কিছু আমাদের মেলামেশা, ভালোবাসা তার সবটুকু দিয়ে ওই গড়ে মালাটি গেঁথে নতুন বউঠান আমার গলায় সেদিন পরিয়ে দিয়েছিল। আমি তা-ই ওটিকে ফেলতে পারিনি।
আমি দরজার কাছে চুপ করে দাঁড়িয়ে।
ও কথা থামিয়ে নীরব।
ঘড়ির কাঁটার শব্দ শোনা যাচ্ছে শুধু।
জিগ্যেস করলুম, মালাটা এখনও আছে?
ও বললে, না ছোটবউ, মালা আর নেই। ওটা নতুন বউঠানের সঙ্গে চিতায় শেষ হয়েছে।
আমার তখনও রবি ঠাকুরের বউ হতে বছর দুই দেরি। আমার বয়েস তখন সাত বছর ক’মাস। আমি তখন যশোর জেলার ফুলতুলি গ্রামের গরিব ঘরের মেয়ে ভবতারিণী। আমাদের গ্রামের চারধারে এক ক্রোশের মধ্যেও কোনও ইস্কুল নেই। আমি কাছেই একটা পাঠশালায় প্রথম বর্গ পর্যন্ত পড়েছি। তারপর লোকনিন্দের ভয়ে পড়া বন্ধ হয়েছে।
এই সময়ে, ১৮৮১ সালে রবি ঠাকুরের বয়েস কুড়ি। আর নতুন বউঠান বাইশ।
রবি ঠাকুরের নতুন বই বেরোল। নাম ‘ভগ্নহৃদয়’। বিয়ের বেশ কয়েক বছর পরে এ-বই আমি প্রথম দেখি। দেখলুম, উৎসর্গের জায়গায় লেখা, শ্রীমতী হে!
কে গো শ্ৰীমতী হে?