তোকে আমি যে-সব চিঠি লিখেছি তাতে আমার মনের সমস্ত বিচিত্র ভাব যেরকম ব্যক্ত হয়েছে এমন আমার আর কোনও লেখায় হয়নি…তোকে আমি যখন লিখি তখন আমার এ কথা কখনও মনে উদয় হয় না যে, তুই আমার কোনও কথা বুঝবি নে, কিংবা ভুল বুঝবি, কিংবা বিশ্বাস করবি নে, কিম্বা যেগুলো আমার পক্ষে গভীরতম সত্য কথা সেগুলোকে তুই কেবলমাত্র সুরচিত কাব্যকথা বলে মনে করবি।
এসব হুবহু ওঁর কথা।
আর কারই বা হবে?
এরকম আর কে লিখতে পারে?
এত ভালো লেগে ছিল, অনেকবার পড়েছিলুম।
তাই ভুলিনি।
একদিন বললুম, বিবির সঙ্গে যেমন মনের কথা বলো, আমার সঙ্গে বলো না কেন?
বলেই মনে হল, ইস! কেন বললুম? নিজেকে খুব ছোট মনে হল। আর খুব লজ্জা করল। আর একটু ভয়ও করল।
উনি রেগে যাবেন না তো?
রাগ তো উনি প্রকাশ করেন না। শুধু গম্ভীর হয়ে যান। উনি কিন্তু সামান্য হাসলেন।
আমি দেখলুম ঠোঁটে হাসিটুকু মিলিয়ে যেতেই ওঁর বড়-বড় চোখ দুটির মধ্যে কেমন যেন ব্যথার ভাব জেগে উঠল।
উনি মৃদুভাবে বললেন, তোমার সঙ্গে মনের কথা কতবার তো বলেছি। আমি কথা বললে তো মনের কথাই বলি।
–কই বলো? শুধু তো সংসারের আর দরকারের কথা বলো।
আবার ওর মুখে হাসি ফুটে উঠল। উনি কী সুন্দর ছড়া করে বললেন—
তুমি মোরে পার না বুঝিতে?
কিছু আমি করিনি গোপন।
যাহা আছে সব আছে তোমার আঁখির কাছে
প্রসারিত অবারিত মন।
আমি বললুম, তুমি আমার এত কাছের মানুষ, তোমার সঙ্গে এত বছর ঘর করছি, তবু তোমার মন কী জানি কেন আমি বুঝতে পারিনে। অন্যদের তো পারি। তোমাকে পারিনে।
এবারও উনি হাসলেন বটে। কিন্তু এইটুকু বুঝলাম, সেই হাসির মধ্যে কোথাও ব্যথা আছে ঠিক ব্যথা নয়, অভিমান। আবার উনি কবিতা করে জবাব দিলেন—এই রকম কিছু একটা–
এ যে সখী, সমস্ত হৃদয়।
এ রাজ্যের আদিঅন্ত নাহি জান রানি।
এ তবু তোমার রাজধানী।
আরও যেন কীসব বলেছিলেন, কোথা জল কোথা কূল, দিক হয়ে যায় ভুল, এইরকম কিছু।
আমি বললুম, কবিতাই বলো আর যাই বলো, তোমার সঙ্গে এত বছর থাকলুম, তোমার ছেলেমেয়ের মা হলুম, তোমার সংসার টানলুম, কিন্তু তোমার মনের কতটুকু পেলুম? অন্যেরা অনেক বেশি পেয়েছে। আমি কতটুকু পেয়েছি বলো? সবসময় মনে হয় একটা আড়াল। কিছুতেই সেই আড়ালের ওপারে যেতে পারিনে।
উনি আমার কথা শুনে হো-হো করে হেসে উঠলেন।
এ-হাসি মোটেই খুশির নয়।
আমি খুব লজ্জা পেলুম।
উনি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আবার কবিতায় বললেন—
নাই বা বুঝিলে তুমি মোরে।
বুঝা যায় আধো প্রেম, আধখানা
মন—
সমস্ত কে বুঝেছে কখন?
আমি মনে-মনে বললুম, কেন, তোমার নতুন বউঠান বোঝেননি? তোমার আদরের ভাইঝি বিবি বোঝে না?
কিন্তু এসব কথা সত্যি-সত্যি বলা যায় নাকি?
বুকের মধ্যে কান্না হয়ে জমে থাকে। বুকটা আমার হিমঘর।
ওখানে অনেক কান্না আর সন্দেহ জমে বরফ হয়ে আছে।
উনি তখন শিলাইদহে। আপন মনে রয়েছেন সেখানে মাসের-পর-মাস।
আমি কলকাতায় সংসার টানছি।
ওঁর চিঠি প্রায় রোজই আসে।
আমাকে লেখেন না।
লেখেন বিবিকে।
আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করে ওঁকে। মন কেমন করে।
কিছুদিনের জন্যে বাচ্চাদের নিয়ে গেলাম ওঁর কাছে।
আমাদের সেই ‘আসা’ নিয়ে উনি বিবিকে চিঠি লিখেছিলেন।
তখন জানতুম না।
পরে একদিন ইন্দিরাই হাসতে-হাসতে দেখিয়েছিল সেই মজার চিঠি।
মজার চিঠিই বটে!
আমাদের রবি ঠাকুর জানাচ্ছেন ইন্দিরাকে, শিলাইদহের আকাশ, পদ্মার বাতাস আর নির্জনতা তাঁকে বেষ্টন করে আছে হৃদয়পুঞ্জের মতো। পরশু থেকে সেই আকাশ-বাতাস-নির্জনতা
আর থাকবে না। কারণ, পরশু তাঁর ওখানে ‘জনসমাগম’ হবে।
জনসমাগম? মানে, আমি, আমাদের ছেলেমেয়েরা ওঁর কাছে অবাঞ্ছিত ভিড়? আমরা এলে নাকি ওঁর পরিচয় পর্যন্ত পালটে যাবে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলুম না—উনি কিন্তু ইন্দিরাকে সত্যিই লিখেছেন—
ওরা এলে আমি তখন তমুকের বাপ, অমুকের স্বামী শ্রীযুক্ত অমুক। সত্যিই তো, এইরকম অবাঞ্ছিত ভিড়ের মধ্যে কি প্রাণের মেয়ে ইন্দিরাকে চিঠি লেখা যায়?
উনি কী করে ভুলে গেলেন, যাকে উনি মনের কথা জানিয়ে প্রায় রোজ লিখছেন, পাতার-পর পাতা, সেই মেয়ের উনি কাকা? শুধু আমরাই পারিবারিক ভিড়?
আর ওঁর আদরের বিবি?
ঠিক কথা, আপনাদের রবি ঠাকুর যা বলেছেন, আমি মেনে নিচ্ছি, আমার কোনও রসবোধ নেই।
কিন্তু রসবোধ যাদের না থাকে, তারা হিসেবে খুব পাকাপোক্ত হয়।
আমি একটা হিসেব করেছি।
১৮৮৭ থেকে ১৮৯৫। এই আট বছরে অন্তত দুশো বাহান্নখানা চিঠি লিখেছেন আপনাদের রবি ঠাকুর তাঁর ভাইঝি ইন্দিরাকে। আর আমাকে দিয়েছেন পনেরোখানি চিঠি, পাঁচটি সন্তান। বেশ করেছেন। আমি নালিশ করছিনা।
আমাকে যদি দুশো বাহান্নটা চিঠি লিখতেন, খুব বিপদে পড়তুম আমি।
আদ্দেক চিঠি তো আমি বুঝতেই পারতুম না।
পারি না পারি, উত্তর তো দিতে হত।
আড়াইশো চিঠি পেলে তো অন্তত পঞ্চাশটা চিঠি লিখতে হত। চিঠি লেখা আমার ধাতে নেই।
উনি আমাকে যে-ক’টি চিঠি লিখেছেন তার ক’টির উত্তর পেয়েছেন উনি?
এই অবিচারটা আমি করেছি। ইচ্ছে যে করত না চিঠি লিখতে তা নয়। কিন্তু যেই মনে হত আমার স্বামী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, এক লাইনও লেখার সাহস হত না।
তবে আমাকে যে-ক’খানি চিঠি উনি লিখেছেন, পড়লে মনে হয় না সেই সব চিঠির লেখক স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। মাঝেমধ্যে কী কর্কশ তিনি!