আমার একটাই কষ্ট—তাঁর জন্যে আরও বেশি কিছু, বড় কিছু করতে পারলুম না। তাঁর কাজের, তাঁর জীবনের প্রেরণা হতে পারলুম না।
দেখুন তো, কোথা থেকে কোথায় চলে এসেছি।
এতবড় একজন লেখকের বউ আমি, নিজের কথাটুকুও গুছিয়ে লিখতে পারছি না।
খালি খেই হারিয়ে যাচ্ছে।
মনে আছে তো, আমি ওঁর আবদার মেটাতে মানকচুর জিলিপি তৈরি করেছিলুম একদিন।
প্রথমে ছেলে রথীকে বললুম, একটু চেখে দ্যাখ তো বাবা কেমন হয়েছে। ও তো বলল, মা, খুব ভালো হয়েছে, সাধারণত আমি যে জিলিপি করি, তার চেয়েও ভালো।
এবার সাহস করে মানকচুর জিলিপি নিয়ে গেলুম ওর লেখার ঘরে। আমি যে ঘরে ঢুকলুম, ও টের পেল না।
একমনে লিখেই চলেছে।
আমি ধীরে-ধীরে প্লেটটা রাখলুম ওর টেবিলে।
ও আমার দিকে একটুক্ষণ তাকাল। তারপর প্লেটটির দিকে একবার তাকিয়েই জিলিপি তুলে মুখে দিল।
মুখ দেখেই বুঝলাম, ভালোলেগেছে, বেশ ভালো। শুধু বললে, মানকচুর জিলিপি পর্যন্ত উতরে দিলে ছুটকি।
ব্যস, আর কিছুনয়। শুধু ওইটুকু।
কী যে ভালোলাগল আমার। কত আনন্দ হল বোঝাই কেমন করে?
০৬. সকাল থেকেই গম্ভীর
সেদিন ও সকাল থেকেই গম্ভীর হয়েছিল।
এক-এক দিন এইরকম—সকাল থেকে নিজের মধ্যে ডুবে থাকে।
আমি ঘরে আলমারি গোছাচ্ছিলাম।
ও খাটের উপর হেলান দিয়ে বসে একটা ইংরিজি বই পড়ছিল। হঠাৎ জিগ্যেস করল, ছোটবউ, তুমি আমার ‘রাহুর প্রেম’ কবিতাটা পড়েছ?
আমি বললুম, না তো! তুমি তো জানো, তোমার আদ্দেক কবিতাই আমি বুঝতে পারিনে।
ও কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। আমি ভাবলুম, এ-প্রসঙ্গে আর কোনও কথা হয়তো বলবে না। সত্যি কথা বলতে ও সাহিত্য আলোচনা শুরু করলে আমি অসহায় বোধ করি, অস্বস্তিতে পড়ি।
কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই ও বলল, ‘রাহুর প্রেম’ কবিতাটা অনেক বছর আগে লিখেছিলেম। আমার ‘ছবি ও গান’ বইয়ে কবিতাটা আছে।
–কী আছে তোমার ওই ‘রাহুর প্রেম’ কবিতায়? কী নিয়ে লিখেছ তুমি?
—ওই কবিতায় আমি আমার কথা বলিনি। বলেছিনতুন বউঠানের মনের কথা।
–নতুন বউঠানের মনের কথা? কী কথা?
–বলতে পারো, নতুন বউঠানই কথা বলছেন, সেই কবিতায়। ছোটবউ, আমি জানি, তোমার মনের মধ্যে অনেক প্রশ্ন আছে আমাকে নিয়ে—সেসব প্রশ্নের উত্তর হয়তো তুমি পেতে এই কবিতায়।
–নতুন বউঠান অনেক বছর হল চলে গেছেন। সবাই তাঁকে ভুলেও গেছে। তাঁর মনের কথা জেনে আমার কী হবে?
ও যেন আমার কথা শুনতেই পেল না। বলতে লাগল, ছোটবউ, আমি তখন দিনরাত পাগল হয়ে ছিলুম। একটা মাতাল অবস্থায় লিখেছিলুম ‘রাহুল প্রেম’ কবিতাটা। তখন যদি তুমি আমাকে দেখতে তো মনে করতে এই ব্যক্তি কবিত্বের খেপামি দেখিয়ে বেড়াচ্ছে। আমি জানতুম না আমি কোথায় যাচ্ছি। এক অন্ধ প্রেম আমাকে গ্রাস করে ফেলেছিল।
আপনাদের রবীন্দ্রনাথ এবার বেশ কিছুক্ষণ চুপ। আমিও আলমারি গোছানো বন্ধ করে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছি।
জানি না কেন, খুব ভয় করছে আমার।
উনি হঠাৎ বললেন আমার দিকে সরাসরি তাকিয়ে, ‘রাহুর প্রেম’ কবিতাটায় নতুন বউঠানের কণ্ঠস্বর আমি আজও শুনতে পাই ছোটবউ—তিনি আমাকে ছেড়ে যাননি, যাবেন না কোনওদিন। এরপর তিনি কবিতাটার কিছু অংশ স্মৃতি থেকে বললেন—
তিনি তখন আমার কেউ নন, তিনি তখন শুধুই রবীন্দ্রনাথ—
নতুন বউঠানের মনের কথা আমি শুনতে লাগলুম তাঁর কণ্ঠে–
চাও নাই চাও, ডাকো নাই ডাকো,
কাছেতে আমার থাকো নাই থাকো,
যাব সাথে সাথে রব পায়ে পায়ে,
রব গায়ে গায়ে মিশি—
এ বিষাদ ঘোর, এ আঁধার মুখ
হতাশ নিশ্বাস, এই ভাঙা বুক,
ভাঙা বাদ্য-সম বাজিবে কেবল
সাথে সাথে দিবানিশি।
নিত্যকালের সঙ্গী আমি যে, আমি যে রে তোর ছায়া—
কিবা সে রোদনে কিবা সে হাসিতে
দেখিতে পাইবি কখনও পাশেতে
কভু সমুখে কভু পশ্চাতে আমার আঁধার কায়া।
গভীর নিশীথে একাকী যখন বসিয়া মলিনপ্রাণে
চমকি উঠিয়া দেখিবি তরাসে
আমিও রয়েছি বসে তোর পাশে
চেয়ে তোর মুখপানে।
উনি থামলেন, আপনাদের রবীন্দ্রনাথ।
এঁকে আমি চিনি না। ওঁর চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হল উনিও আমাকে চেনেন না।
উনি আমার কেউ নন।
আমিও ওঁর কেউ নই।
অন্য এক প্রেম তাঁকে রাহুর মতো গ্রাস করে আছে সারাক্ষণ।
সেই মেয়ে আজও তাঁকে ছেড়ে যায়নি। কখনও ছেড়ে যাবে না।
আমি ঘর থেকে বেরিয়ে অন্ধকার বারান্দায় চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলুম। আমার ভীষণ ভয় করছে যে…
কিন্তু কাকে বলব আমার সেই ভয়ের কথা।
এই কথাগুলো আমি নাই লিখতে পারতুম। এই দিনের ঘটনাটা আলগোছা চলে এল।
কিন্তু না বলেও তো পারলাম না।
আমি তো সত্যিই ঘর করলুম একজনের সঙ্গে, তার ছেলেমেয়ের মা হলুম অথচ সে রইল অন্যের ঘরে—এমন একজনের যে এই পৃথিবীতে নেই, তবু সে আছে—আমার আর ওর মাঝখানটি জুড়ে সে আছে।
কোনওদিন সে যাবে না।
তার কাছ থেকে আমাদের দু’জনেরই মুক্তি নেই।
অন্ধকার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি বুঝতে পারলুম, সে আঁধারের মধ্যে অশরীরী আঁধার হয়ে মিশে আছে।
আর তখুনি মনে এল, অন্য একদিনের গল্প—আমার স্বামীর মুখ থেকে শোনা কথা। ওর মতো করে তো বলতে পারব না। নেহাত আটপৌরে কথাও কী সুন্দর করে বলেন।
আমি আমার মতো করে, আবার যখন মনে পড়বে হুবহু, ওর মতো করেও, মিলিয়ে মিশিয়ে বলি—একটু এলোমেলোও হবে। কিন্তু বারান্দায় অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে তাঁর কথাই—মানে নতুন বউঠানের ভয়ঙ্কর সেদিনের কথাই যে মনে আসছে।