এই খাওয়াদাওয়া, অতিথিসেবা প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা বলি। তাতে ঠাকুরবাড়ির ভিতরের ব্যাপারটা বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠবে। আমিও হয়তো একটু বাহবা পাব।
ওর এক কাকিমা আছেন। ছোট কাকিমা। নগেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী ত্রিপুরাসুন্দরী।
ইনি জোড়াসাঁকোর বাড়িতে জলগ্রহণ করতেন না। কেন তিনি আমাদের বাড়ি কিছু খান না?
কারণ, তাঁর বদ্ধমূল ধারণা, এ-বাড়িতে তাঁর খাবারে বিষ মিশিয়ে তাঁকে হত্যা করা হতে পারে।
কেন হত্যা করা হবে তাঁকে?
বাবামশায় তাঁকে মাসে এক হাজার টাকা হাত খরচা দিতেন।
ছোটকাকিমা ভাবলেন, বাবামশায় তাঁর খাবারে বিষ দিয়ে মাসে ওই হাজার টাকা খরচের হাত থেকে রেহাই পেতে পারেন। যাইহোক, ছোটকাকিমা আমাকে খুব ভালোবাসতেন।
একদিন আমি নিজের হাতে মিষ্টি বানিয়ে ওঁকে খাবার জন্যে অনুরোধ করলেম।
ছোটকাকিমা তো কিছুতেই খাবেন না।
আমিও ছাড়ব না।
অগত্যা শেষ পর্যন্ত উনি সেই মিষ্টি মুখে দিলেন। জলও খেলেন। এবং দিব্য বেঁচে রইলেন।
এরপর আমার উপর কাকিমার আস্থা বাড়ল। একমাত্র আমার তৈরি মিষ্টি উনি মাঝেমধ্যে খেতেন। প্রায় সারাজীবন সর্বক্ষেত্রে আমি হেরে গিয়েছি। এই একটি জায়গায় আমি জিতেছিলুম।
তবে আমার রান্না খেয়ে বিশেষ করে আমার হাতের চিঁড়ের পুলি, আমের মিঠাই, দইয়ের মালপো খেয়ে নাটোরের মহারাজা জগদীন্দ্রনাথ রায় যে কী প্রশংসা করেছিলেন কী বলব! এটাও তো একরকমের জিত, তাই না?
রান্না করতে গেলে তো রান্নার সরঞ্জাম লাগবেই, উপকরণ লাগবে। সুতরাং খরচ তো আছেই।
এই খরচের ব্যাপারেই আমার বর বেশ খিটখিট করে কোনও কোনও সময়ে। একদিন বলল, নীচে বসে লিখতে লিখতে রোজ শুনি, চাই ঘি, চাই সুজি, চিনি, চিড়ে, ময়দা; মিষ্টি তৈরি করতে হবে। যত চাচ্ছ তত পাচ্ছ। মজা হয়েছে খুব।
তোমার মতো গিন্নি হলেই হয়েছে আর কী, দু-দিনে ফতুর। আমি উত্তরে বলেছিলুম, তুমি সংসার বোঝো না, তোমার এদিকে নজর দেয়া কেন?
ও খুব গম্ভীর হয়ে গেল। সারাদিন আর কথাই বলল না। আমার মনে খুব কষ্ট হল। কিন্তু সেই কষ্টের কথা কাকে বলব?
আমার মনের আরও একটা বড় কষ্ট হল, আমাকে দেখতে বেশ খারাপ। কিন্তু ভগবান আমাকে যেভাবে গড়েছেন, তার উপর তো আমার কোনও হাত নেই।
আমার রাগ আমার ভাগ্যের উপর।
আমার এত সুন্দর বর হল কেন?
ওর পাশে আমাকে আরও খারাপ দেখায়, একদম মানায় না। তখন আমি সবে নতুন বউ। ভাবলুম, বাড়িতে বেশ সেজেগুজে থাকব। তাহলে আমাকে আমার অত সুন্দর বরের পাশে খানিকটা অন্তত মানানসই মনে হবে।
একদিন একটু সেজেগুজে মুখে একটু রংটং লাগিয়ে ঘরের মধ্যেই রয়েছি।
মেয়েরা আরও দু-একজন আছেন ঘরের মধ্যে।
হঠাৎ আপনাদের রবি ঠাকুর এলেন ঘরে। সবাই তাকাল ওঁর দিকে।
গায়ে একখানা লাল শাল। কী সুন্দর যে দেখাচ্ছে!
আমি কানে পরেছিলাম দুটি দুলঝোলানো বীরবৌলি।
আপনাদের রবি ঠাকুর একবার শুধু দেখলেন আমার দিকে। আমি সঙ্গে-সঙ্গে হাত দিয়ে কান চাপা দিলুম।
উনি বললেন, অসভ্য দেশের মানুষরাই মুখচিত্তির করে। তুমি কি মুখে রং মেখে অসভ্য দেশের মানুষ সাজতে চাও?
সেই থেকে আর কখনও সাজিনি। নিতান্ত সাদাসিধেভাবেই জীবনের আঠাশটা বছর কাটিয়ে দিলুম।
ভালো কথা, ইচ্ছে করলে গয়না পরবই বা কী করে?
আমার তো আর কোনও গয়নাই নেই।
আমার বিখ্যাত বর শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করল।
আমি তো শুধু তার সহধর্মিণী নই।
তার সহকর্মিণীও হয়ে ওঠবার চেষ্টা করলুম।
ছাত্রদের খাওয়াদাওয়া দেখা-শোনার ভার সব আমার।
ওরা ঘর ছেড়ে, মা-বোন ছেড়ে সব আশ্রমে এসে উঠেছে। ওরা যাতে আমার কাছে মাতৃস্নেহ পায়, অসুখে সেবাযত্ন পায়, দুঃখেকষ্টে সহানুভূতি পায়, সেইদিকে নজর ছিল আমার।
জোড়াসাঁকোর পরিবার ছেড়ে, সেখানকার গোছানো সংসার ছেড়ে শান্তিনিকেতনে এসে থাকাটা আমার খুব সুখের হয়নি।
আমার একমাত্র আনন্দ ছিল ছাত্রদের সেবাযত্ন করা। এইভাবে আমি আপনাদের রবি ঠাকুরের বিদ্যালয়ের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেলুম।
আর যখনই বিদ্যালয়ে অর্থাভাব হত, যখনই ও চাইত, আমি আমার গয়না একটি একটি করে খুলে বিক্রির জন্যে ওকে দিয়ে দিতুম।
গয়না তো কিছু কম ছিল না আমার। শাশুড়ির প্রাচীন আমলের ভারী-ভারী গয়না। বিয়ের যৌতুক হিসেবেও পেয়েছিলেম অনেক গয়না।
সবই একে-একে বিক্রি হয়ে গেল শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়ের খরচ চালাতে। থেকে গেছে শুধু গলার এই চেনটা, যেটা পরে আছি আর হাতে ক’গাছা চুড়ি।
আমাদের আত্মীয়েরা আমাকে প্রচুর তিরস্কার করেছেন গয়না বিক্রি করতে রাজি হয়েছিলুম বলে।
আমার স্বামীকে তো ওঁরা কাণ্ডজ্ঞানহীন মনে করতেন। আমাদের দুজনকেই বিদ্যালয়ের বিষয়ে অনেক বিদ্রূপ সহ্য করতে হয়েছে। একটা কথা, গয়নার জন্যে আমার কোনও কষ্ট বা অনুশোচনা নেই। আমার গয়নাগুলো যে ওর কোনও কাজে লেগেছে, তাতে আমি খুশি।
যে-বিদ্যালয় আপনাদের রবি ঠাকুর প্রতিষ্ঠা করলেন সেটা তো তাঁর সাময়িক শখের জিনিস নয়।
বহুদিন ধরে তাঁর মনের মধ্যে শিক্ষার একটি আদর্শ গড়ে উঠেছিল। সেই আদর্শকেই আপনাদের রবীন্দ্রনাথ রূপ দিতে চেয়েছিলেন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। তাঁর তৃপ্তির জন্যে আমি তাঁর স্ত্রী হিসেবে সামান্য ত্যাগ স্বীকার করেছি মাত্র!