রবি ঠাকুর তো লিখতে বসে গেল। খাওয়াদাওয়া ভুলে দিনরাত একটানা লিখে চলেছে। আমার হল বিপদ। মানুষটাকে খাওয়াব কী করে? আমার সাহসই হচ্ছে না ওকে খাওয়ার কথা বলতে। বলেই দিয়েছে আমি লিখতে যাচ্ছি, খাওয়ার জন্যে আমাকে ডাকাডাকি কোরো না। খেতে গেলে নাকি সময় নষ্ট হয়। তা ছাড়া, খাওয়ার পরে পরিশ্রম করার ক্ষমতাও নাকি কমে যায়, বিশ্রাম নিতে ইচ্ছে করে।
লেখকদের যতদূর সম্ভব না খেয়ে থাকাই ভালো—এইটেই মনে হয় আপনাদের রবি ঠাকুরের মত।
দিনের পর দিন না খেয়েই কাটাচ্ছে আমার বর। বেশ বুঝতে পারছি, ও অসুস্থ হয়ে পড়ল বলে। ও যখন এইভাবে একটানা লেখে, কেমন যেন পাগল-পাগল হয়ে যায়। তখন মনে হয়, ও আমাদের কেউ নয়। ও আমাদের কথা বুঝবে না।
আমি শুধু ওর লেখার টেবিলে কখনও একটু ফলের রস, কখনও শরবত দিয়ে আসছি— ব্যস। সবই নীরবে। ওর সঙ্গে আমার দিনের পর দিন কোনও কথা নেই।
এইভাবে দিনরাত একটানা লিখে ও একটা নাটক শেষ করলে ‘ভারতী’ পত্রিকায় ধারাবাহিক বেরোবে বলে।
নাটকটির নাম, ‘চিরকুমার সভা’। কী মজার লেখা! অথচ খালিপেটে লেখা।
লেখাটা শেষ করেই সেটা নিয়ে ও কলকাতায় চলে গেল। পরের দিনই আমার কাছে খবর এল, জোড়াসাঁকোর বাড়ির তেতলার ঘরে উঠতে সিঁড়িতেই ও অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছে—দিনের পর দিন না খেয়ে একটানা লিখতে লিখতে ওর শরীর এতটাই দুর্বল হয়ে গিয়েছে। এবার আত্মীয়স্বজনের চিঠি আসতে লাগল আমার কাছে–
আমি কেন ওকে ঠিকমতো দেখাশোনা করছি না!
আমিও স্পষ্ট জানিয়ে দিলুম, তোমরা তো ওকে চেনো না। খাওয়ার কথা যত বলেছি জেদ ততই বেড়েছে। কিছুতেই খাবে না। না খেয়ে দুর্বল হয়ে সিঁড়িতে মাথা ঘুরে পড়েছে। এবার হয়তো নিজেই শিখবে। কারও শেখানো কথা শোনবার মানুষ তো ও নয়।
তবে কোনও ব্যাপারেই আমার বরের উপর জোর খাটাতে পারিনি এমন অপদার্থ বউ আমি নই। মাঝেমধ্যে ও আমাকে একটু-একটু ভয়ও পেয়েছে।
আমরা তখন শান্তিনিকেতনে। খবর এল, আমাদের জোড়াসাঁকোর বাড়িতে দুজন মেথরের প্লেগ হয়েছে। সেই সময়ে ওর বন্ধু প্রিয়নাথ সেন ওকে কলকাতায় যাওয়ার জন্যে বললেন— কোনও বিশেষ দরকার ছিল বোধহয়।
আমি বললেম, কলকাতায় এখন প্লেগ হচ্ছে, আমাদের বাড়িতেও দু’জনের হয়েছে, তুমি কিছুতেই কলকাতায় যেতে পারবে না।
ও বললে, বিশেষ প্রয়োজন, যেতেই হবে।
আমি বললেম, যাও তো দেখি কেমন যেতে পারো।
উনি খানিকক্ষণ বিস্মিত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর বন্ধুকে চিঠি লিখে জানালেন, তুমি তো আমাকে কলকাতায় যাওয়ার জন্যে লিখেছ—আমিও অনেকদিন থেকে যাব যাব করছি কিন্তু প্লেগের ভয়ে গৃহিণী যেতে দিচ্ছেন না। এ অবস্থায় কোনও জরুরি কাজের ওজর দেখিয়ে যে আমি ছুটি পাব এমন আশমাত্র নেই। চেষ্টা করে অবশেষে ক্ষান্ত দিয়েছি। বেলা হল। এখন বরং নাইতে খেতে যাওয়া যাক। নইলে নির্দোষী নিরপরাধী তুমি সুদ্ধ গৃহিণীর বিদ্বেষের ভাগী হবে।
কে বলে রবি ঠাকুর বউকে ভয় পায় না? কি, আসল সত্যিটা হল, তিনি নিজেই প্লেগের ভয়ে কলকাতায় গেলেন না?
একটা ব্যাপারে ওর সঙ্গে আমার নিত্য খটাখটি। ব্যাপারটা আপাতভাবে তুচ্ছ হলেও আমার কাছে তুচ্ছ নয়।
যদি কোনওদিন আমার এই আত্মজীবনী কোনও প্রকাশকের হাতে সত্যিই পড়ে এবং সত্যিই ছাপা হয়, তাহলে মেয়েরা অন্তত আমার মনের এই কষ্টটা বুঝবে। এবং রবি ঠাকুরকে অন্তত এ ব্যাপারে দোষ দেবে।
ও সংসার করে সন্ন্যাসীর মতো। অনেক ব্যাপারেই ও সন্ন্যাসী নয়। কিন্তু এ-ব্যাপারে ওর কোনও চাহিদাই নেই।
সংসার করতে গেলে তো নানারকম সরঞ্জাম-উপকরণ লাগে। আমি কোনওরকম বিলাসিতার কথা বলছি না। প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের কথা বলছি। সেগুলিকে ও অপ্রয়োজনীয় জঞ্জাল বলে ভাবে। আর আমার তো সংসার যাযাবরের সংসার। আজ শান্তিনিকেতনে তো কাল কলকাতায়। গাজিপুরে কিছুদিন নিভৃতে সংসার করেছিলুম, সেই যা। তারপর কিছুদিন ও আমাকে নিয়ে থাকল শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে। তারপর শান্তিনিকেতনের অতিথি আবাসে। বাইরের বারান্দায় দিনের-পর-দিন রান্না করেছি। ও আবার পাশে মোড়া নিয়ে বসে নতুন-নতুন রান্নার ফরমাশ করে যাচ্ছে। তারপর রান্নাটা যখন আমি করে ফেললুম, তখন ও বললে, দেখলে তো তোমাদেরই কাজ তোমাদেরই কেমন একটা শিখিয়ে দিলুম।
আমি এই সবই হাসি মুখে মেনে নিয়েছি। মানতে পারিনি একটি জিনিস।
আপনাদের রবি ঠাকুর যখন গৃহস্থালির জিনিসপত্র দেখে বিরক্ত হয়ে মেজাজ খারাপ করেন, তখন আমার খুব রাগ হয়, অভিমান হয়, ভাবি এইমানুষের সঙ্গে ঘর করা যায় না।
এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সংসার পাততে গেলে সংসারের সরঞ্জাম তো বয়ে বেড়াতে হবেই।
হয়তো কখনও কখনও একটু বেশি জিনিসপত্তরই নিয়ে গিয়েছি। সব মেয়েরই ঝোঁক থাকে সেই দিকে।
ও যেখানেই যায়, অতিথি সমাগম হবেই। ব্যস, অতিথি এলেই তাদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা আমাকেই তো করতে হয়।
তখন আনো মালপো, আনো মিঠাই, ভাজো শিঙাড়া, ভাজো নিমকি-কচুরি।
আমার কবি-বরের আবার কিছু কম হলে চলবে না।
পাত্র বোঝাই প্রচুর হওয়া চাই।
কিন্তু বাসনপত্তর, সরঞ্জাম না হলে এসব তৈরি করব কী করে? রাখব কোথায়? পরিবেশনই বা করব কী করে?
কিন্তু সংসারের সরঞ্জাম দেখলেই ও এমন করতে থাকে! কে বোঝাবে ওকে?