আমি যতবার পড়েছি লাইনগুলো আমার বুক কেঁপে উঠেছে। ভাগ্যিস আমার বিয়ের অনেক আগে এই অভিনয় হয়েছিল ঠাকুরবাড়িতে।
আমার সামনে হলে আমি সহ্য করতে পারতুম না।
খুব কষ্ট হত আমার। তবে এখন আর হয় না। এখন মনে মরচে পড়ে গেছে।
আমি তো লাইনগুলো শুধু পড়েছি।
তবু মনে হয়েছে, এসব নতুন বউঠানের মনের কথা। আমার বরেরও নিশ্চয় ভালোলেগেছিল তার সবচেয়ে ভালোবাসার মেয়েটির মুখে এই কথাগুলি। হতে পারে অভিনয়। সে তো শুধু আপাতভাবে।
এ তো একেবারে ভেতরের কথা।
যে বলছে, তার কাছে।
যাকে বলছে, তার কাছেও।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সব জেনেও কী করে ঘটালেন এমন ঘটনা?
তিনি কি ভালোবাসতে পারেননি তাঁর স্ত্রীকে? এতটুকুও? তাই তিনি চাইছিলেন অন্য কেউ তাঁকে ভালোবাসুক?
এ-প্রশ্নের কোনও উত্তর পাওয়া যাবে না কোনওদিন।
শুধু এই বিষয়ে আমি নিশ্চিত, আমার স্বামীর জীবনে যদি নতুন বউঠানের মতো কেউ না আসতেন, তাহলে তিনি আজ যা হয়েছেন এবং পরে হয়তো যা হতে চলেছেন, তা তিনি হতে পারতেন না।
রবি ঠাকুরের জীবনে আমি তাঁর স্ত্রী, তাঁর ছেলেমেয়ের মা, তাঁর সংসারে কাজের লোক।
নতুন বউঠান তো তাঁর ভালোবাসার মানুষ। তাঁর প্রেরণা। এইটুকু বুঝে মেনে নিতে অসুবিধে কোথায়?
০৫. রবি ঠাকুরের মন
আমার রবি ঠাকুরের মন ঠিক শরৎকালের আকাশের মতো।
এই মেঘ। এই রোদ্দু।
এই হালকা। এই গম্ভীর।
সেদিন আমরা ছিলেম জোড়াসাঁকোর বাড়িতে। ও বসেছিল দক্ষিণের বারান্দায়, আরাম কেদারায়। আমি বসেছিলেম মেঝেতে, ওর পায়ের কাছে। আমি তখন ক’মাসের পোয়াতি। ও বেশ হালকা মেজাজেই। সারাদিন লেখার মধ্যে ডুবে কেটেছে।
বিকেলবেলা কী মনে হয়েছে, বারান্দায় এসে বসে বলল, ছোটবউ, ওই যে তুমি একটা গজার মতো মিষ্টি তৈরি করো, ভারি ভালোলাগে আমার, কী যেন নাম ওটার?
আমি বললেম, এলোঝেলো। কবে খেতে চাও বলো, করে দেব।
আমার বর বলল, এলোঝেলো! অমন সুন্দর মিষ্টির এমন বিশ্রী নাম?
আমি বললেম, তুমি একটা জুতসই নাম দাও, এবার থেকে এলোঝেলোকে ওই নামেই ডাকব তাহলে।
রবি ঠাকুর তৎক্ষণাৎ আমাকে চমকে দিয়ে বললে, ‘পরিবন্ধ।’
কোথায় এলোঝেলো। কোথায় ‘পরিবন্ধ’। ’পরিবন্ধ’ মানে কী? উনি একটু হেসে বললেন নতুন বউঠানকে একদিন বলেছিলেম, সে যখন চুলবেঁধে এসে দাঁড়াল, তখন বলেছিলেম বেঁধেছ কবরী তুমি নানা পরিবন্ধে—পরিবন্ধ মানে বৈচিত্র্যের বাঁধুনি, যেমন তোমার এলোঝেলো—কত রকমের গজার মিশ্রণ!
মোটেই পছন্দ হয়নি আমার নামটা। কিন্তু স্বয়ং রবি ঠাকুর নাম দিয়েছে—চুপ করে মেনে নিলেম।
শুধু রান্নার নাম নয়, রান্না নিয়েও অনেক এক্সপেরিমেন্ট করতে ভালোবাসে আমার বর।
যশোরের মেয়ে আমি। যশোরের বেশ নামডাক আছে নিরামিষ রান্নার জন্যে। আমি নানারকম নিরামিষ রান্না জানি।
আমার ঢাকাই রান্না শেখারও খুব শখ। কেউ আমাকে ঢাকার রান্না শেখালে আমি তাকে যশোরের রান্না শিখিয়ে দিই।
আমার বর আমার হাতের নিরামিষ রান্নার তারিফ করেছে। বলেছেন, এই একটি ব্যাপারে আমি নাকি অদ্বিতীয়।
বিশেষ করে আমার হাতে তৈরি মিষ্টি খেতে ও বড় ভালোবাসে।
এইখানে আমি জিতেছি। নতুন বউঠান নাকি খুব ভালো মিষ্টি বানাতেন।
আমার বর বলেছে, আমি তাঁর চেয়েও ভালো এই ব্যাপারে।
শান্তিনিকেতনে নিজেদের বাসের জন্য আলাদা বাড়ি তখন ছিল না।
আমরা থাকতেম আশ্রমের অতিথিশালার দোতলায়। রান্নাবাড়িটা ছিল দূরে।
রবি ঠাকুর বললে, পৃথক কোনও রান্নঘর নেই, ওই বাইরের বারান্দার এক কোণে উনুন পেতে তুমি রান্না করবে।
আমি তাই করতেম। ছুটির দিনে আমি নানারকম মিষ্টি তৈরি করতুম। তারপর সেগুলিকে একটা জালের আলমারিতে রেখে দিতুম। রথী জালের আলমারি চুপিচুপি খুলে মিষ্টি খেত। আমি আড়াল থেকে দেখে ভারি মজা পেতুম।
একদিন আপনাদের রবি ঠাকুর মজা করে বললে, ছোটবউ তোমার জালের আলমারিটি দেখছি মিষ্টান্নের অক্ষয় ভাণ্ডার—লোভনীয় জিনিসে সদাই ভরতি। দেখেছি রথী তার সহপাঠীদের নিয়ে এসে তোমার ওই মিষ্টির ভাণ্ডার প্রায়ই লুট করে।
এই মিষ্টির ভাণ্ডারের পিছনে আমার বরের নানারকম চাহিদার দানও কিছু কম নয়।
কতরকমের নতুন-নতুন মিষ্টির জন্যে তার আবদার। আমাকে সেইসব আবদার মেটাতে হয়।
একদিন রান্না করছি, হঠাৎ চৌকিটা টেনে পিছনে বসে বললে, মানকচুর জিলিপি করে খাওয়াও তো দেখি। ঠিক-ঠিক করতে পারলে ভালোই হবে। আর বাঙালিরা ঘরে ঘরে তোমার জয়গান করবে।
মানকচুর জিলিপি! কী পাগলের মতো বলছ বলো তো? তোমার এই আবদার আমি রাখতে পারব না।
আবদার নয় ছোটবউ, বলতে পারো ফরমাশ। তোমাকে করতেই হবে মানকচুর জিলিপি। দেখলাম, রবি ঠাকুরের মুখে মৃদু হাসি।
সেই হাসি আমাকে উৎসাহ দিল। সত্যিই সারা দুপুর ধরে তৈরি করলেম মানকচুর জিলিপি।
রথী, খেয়ে দ্যাখ তো কেমন হয়েছে। ওকে দেওয়ার আগে ছেলেকেই দিলুম।
রথী বলল, মা, তুমি যে সাধারণ জিলিপি করো, তার চেয়েও ভালো।
সন্ধেবেলা আপনাদের রবি ঠাকুর কী যেন লিখছেন। একেবারে মগ্ন হয়ে আছেন। আমি লেখার সময় ওকে বিরক্ত করি না। ডাকলেও অনেক সময় সাড়া পাওয়া যায় না। লেখার ঝোঁক চাপলে ও খাওয়াদাওয়া ছেড়েই দেয়।
আমি প্রথম প্রথম রাগারাগি করতেম। কোনও ফল হয় না। এখন আর রাগারাগি করি না। এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলি। ’ভারতী’ পত্রিকায় বিজ্ঞাপন বেরিয়ে গেছে, পরের মাস থেকে সেই কাগজে রবি ঠাকুরের লেখা নিয়মিত বেরোবে। এদিকে আমার বরকে বলাই হয়নি এমন একটা বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞাপন বেরোবার পর সে জানল। এবার কী হবে?