রবি ঠাকুর আবার চুপ করলেন।
আমি হঠাৎ বুঝলাম, পায়ের তলায় কোনও মাটি নেই আমার। আমার বুক ঘামে ভিজে যাচ্ছে।
জানলার ধারে চুপ করে গিয়ে দাঁড়ালাম।
বিলেত থেকে আমার বর ফিরে এল। নতুন বউঠান তার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। এ যেন ছেলেবেলার বন্ধু, খেলার সাথীকে নতুন করে পাওয়া।
গল্পটা কিন্তু আরও অনেক দূর গড়াল।
আপনাদের রবি ঠাকুর আমাকে সবটা বলেননি। যা বলেছেন তার মধ্যেও অনেক আড়াল আছে।
আমি একটু একটু করে সেই আড়াল সরাবার চেষ্টা করেছি।
কেন করেছি?
হয়তো আরও ব্যথা পেতে ভালোলেগেছে, তাই।
স্বামীর জীবনে তার জায়গা ঠিক কোথায়, সেইটুকু অন্তত জানতে কোন স্ত্রীর না ইচ্ছে করে?
আড়াল সরিয়ে আমি সত্যিটা জানতে চেয়েছি সেই কারণেও।
আর একটা কারণ আছে।
রবি ঠাকুর কেন আমাকে বিয়ে করলেন?
এই প্রশ্নের উত্তর পেতেও আমার এই আড়াল সরিয়ে-সরিয়ে সন্ধান। একটা কথা বলি, যত আমি এগিয়েছি সত্যের দিকে, ততই আমি আমার স্বামীকে আমার মতো করে ভালোবেসেছি, আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করেছি। তাঁকে ভালোবেসেছি আমার জীবনে দুঃখদানের দেবতা হিসেবে। আর বেদনাও পেয়েছি ততই বেশি।
আমার ভিতরটা বরফ হয়ে গেছে। আমার বরের বয়েস তখন একুশ। নতুন বউঠান তেইশ। শোনা কথা, গুজব, উড়ো গল্প থেকে আমি বুঝতে পাচ্ছিলুম আস্তে আস্তে যে আমার বর আর তার নতুন বউঠানের সম্পর্কটা হয়ে উঠল খুব গভীর ভালোবাসার সম্পর্ক।
আমি আপনাদের রবি ঠাকুরের সঙ্গে এত বছর ঘর করলুম, তাঁর পাঁচ ছেলেমেয়ের (না কি ছয় বলব?) মা হলুম,—তাঁকে আমি যতটুকু বুঝেছি, তিনি আর কোনও মেয়েকে নতুন বউঠানের মতো ভালোবাসেননি। আমার বর বিলেত থেকে ফিরে আসার পর ঠিক কী হয়েছিল?
এক কথায়, ঠাকুরবাড়িতে নতুন প্রাণের জোয়ার এসেছিল।
রবি ঠাকুর কবিতায়, গানে, সাহিত্যচর্চায় ভরিয়ে দিলেন, ভাসিয়ে দিলেন।
সেই জোয়ার নতুন বউঠানকে ভাসিয়ে নিয়ে এল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির একেবারে মাঝখানে।
আর যিনি ছিলেন মাঝখানে, জ্ঞানদানন্দিনী, তিনি ভেসে চলে গেলেন দূরে।
সব আলো এসে পড়ল কাদম্বরীদেবীর মুখে।
আমার বর গান লেখে, সুর দেয়, কবিতা লেখে—সবই তারই জন্যে। আর নতুন বউঠান টিপ্পনি কেটে বলেন, যতই লেখো না কেন, বিহারীলালের মতো লেখা তোমার দ্বারা সম্ভব হবে না। আমার বর তখন তার নতুন বউঠানের মন পাওয়ার জন্যে বিহারীলালের অনুকরণ করেও লিখেছে।
তার কাছ থেকে জেনেছি সেই গল্প—
বউঠাকরুণের ব্যবহার ছিল উলটো। আমি যে সত্যি-সত্যি কোনওকালে কিঞ্চিৎ লিখতে টিখতে সক্ষম হব এ সে কিছুতেই যেন মানতে পারত না। কেবল খোঁটা দিত আর বলত, ঠাকুরপো, বিহারী চক্রবর্তীর মতো লেখার চেষ্টা করছ, বটে, কিন্তু সে তুমি পারবে না। একথা বলবার পরেই নতুন বউঠান আড়চোখে হাসত। ভারি দুষ্টুমিভরা সেই হাসি।
আমার বর বোধহয় ক্রমেই বুঝতে পেরেছিল, এইভাবেই তার নতুন বউঠান তাকে আরও ভালো লেখার উৎসাহ দিচ্ছেন।
নতুন বউঠানই ছিলেন তাঁর লেখার প্রধান প্রেরণা। প্রিয় ঠাকুরপোটি দুপুরবেলা নতুন বউঠানের পাশে শুয়ে তার লেখা পড়ে শোনাত। আর হাতপাখা নেড়ে বাতাস করতেন নতুন। বউঠান।
সে-গল্প যে কতবার শুনেছি আমার বরের মুখে।
এই গল্প শোনাতে তার ভালোলাগে, নতুন বউঠানকে যেন চোখের সামনে দেখতে পায়। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ছোটবউ, দুপুরবেলা জ্যোতিদাদা নীচের তলায় কাছারিতে চলে গেল।
বউঠাকরুণ ফলের খোসা ছাড়িয়ে কেটে-কেটে যত্ন করে রুপোর রেকাবিতে সাজিয়ে দিচ্ছে। নিজের হাতে তৈরি মিষ্টি—তাও সে কিছু দিয়ে দিচ্ছে সঙ্গে। কী সুন্দর করে গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে দিচ্ছে নতুন বউঠান। সঙ্গে পাঠাচ্ছে ডাবের জল কিংবা বরফে ঠান্ডা করা তালশাঁস। সমস্তটার উপর রেশমের রুমাল বিছিয়ে মোরাদাবাদি খুনচেতে করে জলখাবার পাঠিয়ে দিত নতুন বউঠান রোজ দুপুরবেলা জ্যোতিদাদার জন্যে। তার মনটা ভালোবাসায় ভরা ছিল। সেই সহজ সরল ভালোবাসাকে ভালোবাসার মতো মানুষ নতুন বউঠান পায়নি। এইটে ছিল নতুন বউঠানের সবচেয়ে ব্যথার জায়গা ছোটবউ।
একটা কথা এখানে না বলে পারছিনা।
আমার তো মনে হয় ওঁর নতুনদাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ক্রমে বুঝতে পারছিলেন তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে প্রিয় দেওরটি প্রেমে পড়েছে। আর স্ত্রীও যে ভালোবাসার মতো একটি মানুষ পেয়েছেন এই সংসারে, সে-বিষয়েও আমার মনে হয় কোনও সন্দেহ ছিল না জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মনে।
এক অদ্ভুত মানুষ ছিলেন তিনি। তিনি হয়তো ভিতরে ভিতরে কষ্ট পেয়েছেন, তবু আমার বর আর ওঁর স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কটা আরও গভীর, আরও ঘনিষ্ঠ করে দেওয়ার পিছনেও তিনি।
তিনি সব দেখছিলেন, সব বুঝছিলেন। তবু এমন নাটক লিখলেন যাতে উর্বশীর ভূমিকার অভিনয় করলেন নতুন বউঠান আর মদনের ভূমিকায় আপনাদের রবি ঠাকুর। এ তো আগুনে ঘি ঢালা।
এখানেই থেমে থাকেননি এই অদ্ভুত মানুষটি। তিনি লিখলেন আর এক নাটক ‘অলীকবাবু।’ সেই নাটকের নায়ক আমার বর, নায়িকা নতুন বউঠান। দুপুরবেলা খাটে শুয়ে-শুয়ে এই নাটকের মহড়া দিতেন নতুন বউঠান তাঁর ঠাকুরপোর সঙ্গে।
অলীকবাবু আমি পড়েছি। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তাঁর স্ত্রীকে দিয়ে এই কথাগুলো তাঁর প্রিয় ঠাকুরপোকে বলিয়েছেন—আমি জগতের সমক্ষে, চন্দ্রসূর্যকে সাক্ষী করে মুক্তকণ্ঠে বলব, লক্ষবার বলব, তুমিই আমার স্বামী, শতবার বলব, সহস্রবার বলব, লক্ষবার বলব, আমিই তোমার স্ত্রী।