বিলেতের বিবিরা তাকে বদলে দেয়নি তো?
নতুন বউঠানকে আর কি সে আগের মতো ভালোবাসবে?
এই ভয়, অনিশ্চয়তা তো নতুন বউঠানের মনে ছিলই। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই নতুন বউঠানের মনের মেঘ কেটে গেল।
বিলেত থেকে ফিরেই নতুন বউঠানের তেতলার ছাদের ঘরের সামনে বাগান করতে শুরু করলেন তাঁর প্রিয় ঠাকুরপো।
সেই বাগান তৈরির গল্প উনি একদিন আমাকে শুনিয়েছিলেন শিলাইদহে।
সে এক বর্ষার সন্ধে।
তোড়ে নামল বৃষ্টি। উনি বসেছিলেন শোবার ঘরে জানলার পাশটিতে। কুঠিবাড়ির সামনে ধু-ধু পদ্মার চর।
জানলার পাশটিতে বসে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে ছিলেন। পাশে পাথরের টেবিলে জ্বলছে একটি শামাদান।
সেই আলোয় ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে ওঁকে।
আমি সেইদিকে তাকিয়ে বসে আছি কাছেই খাটের উপর।
উনি বললেন, বিলেত থেকে ফিরে নতুন বউঠানের সঙ্গে বাগান করতে শুরু করলেন।
এই কাজটি করতে বউঠাকরুণ খুব উৎসাহ পেল। নিজের মধ্যে যে শোকের মন্দিরটি সে তৈরি করে তারই ভিতর নিঃসঙ্গ নির্বাসনে দিন কাটাচ্ছিল, সেখান থেকে আমার সঙ্গে বাগান তৈরির কাজ তাকে বের করে আনল। লতা-পাতা-ফুল-ফল-পাখির ডাক ছাড়া এই কাজটি সম্ভব হত না।
আমি ওঁর কথা শুনে হঠাৎ বলে ফেললুম ওসব ডাকের কোনও মানেই হত না তোমার ভালোবাসার ডাক না থাকলে।
উনি খুব ধীরে-ধীরে বললেন, খুব ভালোবাসতেম নতুন বউঠানকে, বউঠাকরুণও আমাকে খুব ভালোবাসত।
তারপর আরও কথা বললেন উনি—ওই একবারই—আর কখনও বলেননি।
বললেন, সেইসব দিনগুলির কথা খুব মনে পড়ছে। সেই সুন্দর দিনগুলোকে যদি সোনার খাঁচায় বন্দি করে রাখতে পারতেম! বিলেত থেকে ফিরেই নতুন বউঠানের চোখের দিকে তাকিয়ে একটি কথা আমি বুঝতে পেরেছিলেম—নতুন বউঠান কোনওদিন মুখ ফুটে বলেনি, আমি কিন্তু অনুভব করেছিলেম বউঠান এক অসহায় একাকিত্ব এবং ঠাকুরবাড়ির নানা তির্যক অপমান থেকে একটা মুক্তির পথ খোঁজার চেষ্টা করছে। আর তার ভিতরটা ছটফট করছে।
ছোটবউ, আমি ছাড়া ঠাকুরবাড়িতে আর কেউ ছিল না যে নতুন বউঠানের মনের খোঁজ রাখত। এই কথাটা আমি বিলেত থেকে ফেরার পরেই প্রথম সঠিকভাবে উপলব্ধি করলেম।
নতুন বউঠান আমার সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাগান তৈরি করল।
আমি বললেম, বউঠান বাগান তো ফুলে-ফলে-লতায়-পাতায় ভরে উঠেছে। এবার তুমি বাগানের একটা নাম দাও।
নতুন বউঠান একটুও না ভেবে বলল, ঠাকুরপো, তুমি থাকতে আমি দেব নাম?
আমিও একটুও না ভেবে বললাম, নন্দনকানন।
বউঠানের নামটি ভারি পছন্দ হল। আমরা তখন শরৎকালের এক বিকেলবেলায় বাগানের মাঝখানটিতে দাঁড়িয়ে।
বউঠান মুখে কিছু বলল না। শুধু একবার তাকাল আমার চোখের পানে।
সেই দৃষ্টি মনে থাকবে চিরকাল। আর…
আর কী? প্রশ্ন করে ফেললুম ওঁর কথার মাঝখানে।
উনি বললেন, কী আর? বললেম বউঠান, আমাদের এই বাগানে রূপকথার রাজকন্যার মতো তোমাকে নিজের হাতে গাছে জল দিতে হবে।
নতুন বউঠান আমার হাতে হাত রেখে বলল, ওই পশ্চিমের কোণটাতে একটা কুঁড়ে তৈরি করে দিও, হরিণের বাচ্চা থাকবে।
আমি বললেম, আর একটি প্রস্তাব আছে বউঠান।
বউঠান প্রশ্ন না করে একটু হাসল।
আমি বললেম, যেন সেই হাসির উত্তরে, আর একটি ছোটখাটো ঝিল থাকবে, তাতে দু-চারটি হাঁস চরবে।
বউঠানের সে কী উৎসাহ, বললে শুধু ঝিল আর হাঁস হলে চলবে না ঠাকুরপো। ঝিলের মধ্যে তুমি-আমি দুজনে ফুটিয়ে তুলব নীলপদ্ম। আমার অনেক দিন থেকে নীলপদ্ম দেখবার সাধ আছে।
আমি বললেম, বেশ তো বউঠান, সেই নীলপদ্মের ঝিলের উপর একটি সাঁকো বেঁধে দেওয়া যাবে আর ঘাটে থাকবে ছোট্ট একটি ডিঙি। আমার কথা শোনামাত্র বউঠান বললে, ঘাট অবশ্য সাদা মার্বেলের হবে।
গল্পটা এই পর্যন্ত বলে আপনাদের রবি ঠাকুর অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন।
বাইরে বৃষ্টিও তখন প্রায় ধরে এসেছে।
আমি ভাবলুম, এই একান্ত ব্যক্তিগত কাহিনি উনি আর বেশিদূর আমাকে বলতে চান না।
আমি খাট থেকে নেমে টেবিলে শেজের আলোটা একটু উস্কে দিলুম। আর উনি তখুনি বললেন, কোনও একদিন একটা গল্প লিখব যেখানে বউঠান আর আমার এই বাগান করার ব্যাপারটা থাকবে।
–কী নাম দেবে সেই গল্পের?
–নষ্টনীড়।
–নষ্টনীড়? বাগান নিয়ে গল্প, তার নাম নষ্টনীড়? আমি তো অবাক।
—সে তুমি বুঝবে না ছোটবউ। গল্পটা তো বাগান নিয়ে হবে না। বাগানটা থাকবে, কিন্তু গল্পটা হবে এক নারীর গল্প, যে-নারী চারদিক থেকে আক্রান্ত। তার জন্যে এ-পৃথিবীতে এমন স্থান নেই যেখানে সমস্ত হৃদয় উদঘাটিত করে দিয়ে সে হাহাকার করে উঠতে পারে—বাগানটা তার হৃদয়ের মধ্যেই একটু-একটু করে মরে গেল।
—সেই মেয়েটির স্বামী—তিনিও কি বোঝেন না মেয়েটির মনের কষ্ট?
—তার স্বামীর মনের কথা দিয়েই শেষ হবে আমার সেই গল্প।
–কী তার স্বামীর মনের কথা? আমি প্রশ্ন না করে পারলুম না। কেন জানি না আমার সারা বুক জুড়ে তখন ছড়িয়ে পড়ছে তীব্র এক যন্ত্রণা। আর ভয় করছে। কীসের ভয়!
রবি ঠাকুর বললেন, ধরো আমার সেই গল্পের একেবারে শেষে নিঃশব্দে স্বামীটি ভাবছে— আমি কোথায় পালাব? যে স্ত্রী হৃদয়ের মধ্যে নিয়ত অন্যকে ধ্যান করে, নির্জন বন্ধুহীন প্রবাসে তাকে সঙ্গদান করব কী করে? যে-স্ত্রীর অন্তরের মধ্যে অন্য পুরুষের ভাবনা, তাকে বুকের কাছে ধরে রাখার যন্ত্রণা কতদিন সহ্য করতে পারব? যে-আশ্রয় চূর্ণ হয়ে গেছে তার ভাঙা ইটকাঠগুলো আমাকেই বাকি জীবন কাঁধে করে বয়ে বেড়াতে হবে?