এখানে একটু যেন কী ভাবলেন আপনাদের রবি ঠাকুর। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, নতুন বউঠানকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলুম বিলেতের মেয়েদের কথা—সবার নাম জানাতাম, মিস ভিভিয়ান, মিস লং, মিস মুল আর অবশ্যই মিস লুসি স্কট। এইসব বিলিতি বিবিরা যে আমার আকর্ষণে সাড়া দিয়েছিল সেকথা নতুন বউঠানকে গর্বভরে জানাতে দ্বিধা করিনি। তবে নতুন বউঠান নিশ্চয়ই ভাবত, আমি যেরকম লাজুক আর মুখচোরা, বিলেতের তরুণীমহলে আমি কিছুতেই ভিড়তে পারব না। সেটা অবিশ্যি বউঠাকরুণের ধারণা। বিলেতের সব মেয়েদের সঙ্গে আমার অভিজ্ঞতা একরকম নয় ছোটবউ। মেয়েরা এমন বিচিত্র বলেই তো তাদের আকর্ষণের এতরকম রং। লুসিকে ভালোলাগত তার চাপল্যের মাধুর্যের জন্যে। ভিভিয়ান ছিল অস্পষ্ট, কেমন যেন ইশারাময়। মিস লং চাইত আমার সঙ্গে অরণ্যের নির্জনতায় যেতে। আর মিস মুল ভালোবাসত নাচতে-গাইতে। একটা কথা বলতে পারি, এদের সান্নিধ্যে আমার লজ্জা ভাঙল, দ্বিধা ঘুচল। একটি চিঠিতে মনে পড়ে, এসব কথা লিখেও ছিলুম নতুন বউঠাকরুণকে।
বিলেতের তরুণীমহলে যখন আমার বরের প্রতিষ্ঠার কানাঘুষো এসে পৌঁছোচ্ছে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে, তখন সেই বাড়িতেই কেমন ছিলেন নতুন বউঠান? কী নিয়ে কীভাবে কাটছিল তাঁর দিনরাত?
নতুন বউঠানের বয়েস তখন কুড়ি ছুঁইছুঁই। তাঁর প্রাণের মানুষটি বিলেত চলে যাবার পর তিনি ছিলেন ঠাকুরবাড়ির সবচেয়ে একলা মানুষ। এবং এই অপবাদের অপমান তাঁকে বয়ে চলতে হচ্ছিল যে তিনি বাঁজা। তাঁর কোনওদিন বাচ্চা হবে না। ঠাকুরবাড়ির মহিলামহলে তিনি ছিলেন সবচেয়ে অপমানিত। একে বাজার সরকারের মেয়ে, তায় সন্তান ধারণে অক্ষম, তায় আবার গায়ের রং কালো কোথায় লেখাপড়া জানা মাজাঘষা ঝকঝকে জ্ঞানদানন্দিনী যিনিও তখন বিলেতে, আর কোথায় ঠাকুরবাড়ির বাজার সরকারের মেয়ে—এ-মেয়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী! বিয়েটাকেই তো অনেকে অচল বলে ধরে নিয়েছিলেন। মাথা নিচু করে এই অচল বিয়ের অপবাদ মেনে নেওয়া ছাড়া নতুন বউঠানের কোনও উপায় ছিল না।
তিনি একটি জিনিস মনেপ্রাণে চাইছিলেন—কেউ তাঁকেও ভালোবাসুক। সেই ভালোবাসা তিনি পেলেন ছোট্ট ঊর্মিলার কাছ থেকে।
কে এই ছোট্ট মেয়ে যাকে বুকে করে বেঁচে থাকতে চাইলেন নতুন বউঠান?
উর্মিলা হল আমার বরের ন’দিদি স্বর্ণকুমারী দেবীর মেয়ে।
নিঃসন্তান নতুন বউঠান বুকে টেনে নিলেন এই মেয়েটিকে।
ঊর্মিলার কাছ থেকে তিনি পেলেন একটি শিশুর নিখাদ ভালোবাসা। নতুন বউঠানই এই শিশুকে দেখতেন শুনতেন খাওয়াতেন পরাতেন। নতুন বউঠানের ঘর ছিল বাইরে, তেতলার ছাদে। বাড়ির অন্দরমহলের বাইরে থাকতেই হয়তো তিনি আরাম পেয়েছিলেন।
শুনেছি ওই ছাদের ঘরে একাই থাকতেন তিনি উর্মিলাকে নিয়ে। যেন তাঁরই মেয়ে ঊর্মিলা।
বাড়ির অন্দরমহলের সঙ্গে মা-মেয়ের তেমন সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু এই সুখ সইল না নতুন বউঠানের ভাগ্যে।
তেতলার ছাদের ওই ঘরের পাশেই ছিল নীচে যাওয়ার লোহার সিঁড়ি।
নতুন বউঠানের চোখের আড়ালে ছোট্ট উর্মিলা একাই নামতে গেল সেই সিঁড়ি দিয়ে।
শীতের সন্ধে। জায়গাটা অন্ধকার।
উর্মিলার পা গেল ফস্কে। লোহার সিঁড়ি দিয়ে গড়াতে গড়াতে সে পড়ে গেল নীচে।
মাথায় আঘাত লেগে অজ্ঞান হয়ে গেল।
আর জ্ঞান ফিরল না উর্মিলার।
এই ঘটনার পরে যা হওয়ার তাই হল। একে বাঁজা তায় অপয়া, অলক্ষ্মী—ঠাকুরবাড়ির মেয়েমহলে একঘরে হয়ে গেলেন নতুন বউঠান। তার মুখ দেখলেও অকল্যাণ হয়—এমন রটনাও শোনা গেল ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে।
একদিন শান্তিনিকেতনে আপনাদের রবি ঠাকুরের মুখেই শুনেছিলুম এই ঘটনার পরে নতুন বউঠান কেমন ছিলেন, সেই কথা।
কী গভীর গম্ভীরভাবে বলেছিলেন তিনি কথাগুলি। ওঁর মুখের কথা, যতটুকু মনে আছে, এইখানে লিখে দিলুম—এই ঘটনার পর নতুন বউঠান আরও নিঃসঙ্গ হয়ে গেল। কারও সঙ্গে আর তেমন মিশত না। বিলেত থেকে ফেরার কিছুদিনের মধ্যেই এক নতুন ভাবে বউঠাকরুণকে আবিষ্কার করলেম।।
এই মেয়ে যেন তার সমস্ত ঘরকন্না, সমস্ত কর্তব্যের তলায় একটা সুড়ঙ্গ কেটে সেই নিস্তব্ধ অন্ধকারের মধ্যে একটি গোপন শোকের মন্দির তৈরি করে তারই মধ্যে আশ্রয় নিয়েছে— সেখানে তার স্বামী বা কারও কোনও অধিকার নেই।
উনি দেড় বছর পর বিলেত থেকে ফিরলেন।
যে নতুন বউঠানকে উনি ফেলে গিয়েছিলেন আর যাঁর কাছে ফিরে এলেন উনি, তাঁরা কি একই মানুষ?
তা কি হতে পারে?
দেড় বছর যে অনেক সময়।
আমার তো মনে হয় অনেক ব্যথা, অভিমান, অপমান, একাকিত্ব আর ভালোবাসা নিয়ে নতুন বউঠান পথ চেয়ে বসেছিলেন ওঁরই জন্য। নতুন বউঠান যে নিজের মধ্যে আরও ঢুকে গেছেন, তাঁর ভেতরটা যে এখন নির্জন শোকের মন্দির—একথা ঠাকুরবাড়ির আর কেউ না বুঝুক, উনি বিলেত থেকে ফিরেই বুঝতে পেরেছিলেন। কী করে নতুন বউঠানকে বের করে আনা যায় সেই শোকের মন্দির থেকে? তাঁর মনের অন্দরমহলে, যেখানে তাঁর স্বামীরও অধিকার নেই, কেমন করে প্রবেশ করা যায় সেখানে? পারবেন কি আপনাদের উনিশ বছরের রবি ঠাকুর তাঁর একুশ বছরের নতুন বউঠানের মনের গোপন অন্ধকারে অধিকারের আসনটি পাততে?
নতুন বউঠান তাঁর রবির সঙ্গে পুনর্মিলনের অপেক্ষাতেই তো দিন গুনছিলেন। বিলেত যাওয়ার আগে তাঁর কাছে বসেই তো রবি লিখত, পড়ত।