সব মেয়েরই বুকের মধ্যে ভালোবাসার জন্যে একটা তীব্র তেষ্টা থাকে। আমার তেষ্টা থেকেই সেকথা আমি বুঝতে পেরেছি।
নতুন বউঠানের তো কোনও বাচ্চা হয়নি। মেয়েরা মা হলে অনেক অভাব পূর্ণ হয়ে যায়।
নতুন বউঠানের মনের ভিতরটা খাঁ-খাঁ করত। খুব দুঃখী ছিলেন তিনি। রবি ঠাকুরের ভালোবাসা নতুন বউঠানের মনের কষ্ট অনেকটাই জুড়িয়ে দিয়েছিল।
হঠাৎ যখন তাঁর অনেক ভালোবাসার দেওরটি বিলেতে চলে গেল, কী ভাবে দিন কেটেছিল তাঁর?
একবারও কি কেউ ভেবে দেখেছে সেকথা?
এমনকী সতেরো বছরের রবি ঠাকুরের কি সেকথা ভাববার সময় ছিল?
না, ছিল না। কিন্তু রবি ঠাকুরের কথায় পরে আসছি।
প্রথমে নতুন বউঠানের কথা।
১৮৬৮ সালে তিনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বউ হয়ে এ-বাড়িতে আসেন। আর ১৮৭৮-এ, অর্থাৎ দশ বছর পরে তাঁর পরম বন্ধু, প্রিয়তম মানুষটি তাঁকে ছেড়ে চলে গেল সাতসমুদ্র পেরিয়ে এক অজানা দেশে। কবে সে ফিরবে, কেমন হয়ে ফিরবে, ফিরে আর নতুন বউঠানকে মনে ধরবে কি না, কিছুই তাঁর জানা নেই।
বাড়ির লোকজন সবাই তাঁকে হেয় করে। কেউ তাঁকে ভালোবাসে না। নতুন বউঠানের বুকের ভিতরটা কতখানি হু-হু করত সারাক্ষণ তাঁর প্রিয় মানুষটির জন্যে, তা আন্দাজ করা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। একা ঘরে কত নিঃসঙ্গ কান্নাই না তিনি কেঁদেছেন তখন।
এই যে দশ বছর তিনি ঠাকুরবাড়ির বউ হয়ে দিনরাত অবহেলা আর চাপা অপমান সহ্য করেছেন, তার মধ্যে একমাত্র তাঁর ঠাকুরপোর মমতাই যেন নতুন বউঠানকে বাঁচিয়ে রেখেছিল।
প্রথম ক’বছর তো খেলার সাথি। তারপর প্রিয় রবি যখন মাতৃহারা হল, সেই মাতৃহারা বালকটিকে স্নেহে-মায়ায়-মমতায় যে মেয়েটি ঘিরে থাকল, মায়ের অভাব বুঝতে দিল না, সেও তো বালিকাই তখন। কিন্তু তবু যেন রাতারাতি কত বড় হয়ে উঠল সেই মেয়ে—রবি ঠাকুরের নতুন বউঠান।
রবি ঠাকুরের বয়েস তখন বছর বারো। আর নতুন বউঠান চোদ্দো বছরের। বালিকা বলব? না কিশোরী?
আমার যে তাঁকে কিশোরী বলতেই ইচ্ছে হচ্ছে। রাধিকা তো ওই বয়েসেই রাইকিশোরী হয়ে উঠেছিল। আর আমি তো সে-বয়েসে মা হয়ে গেছি।
বারো বছরের রবি ঠাকুরের পৈতে হল। তার জন্যে কে বেঁধে দিল হবিষ্যি?
কে আবার, চোদ্দো বছরের সেই রাইকিশোরী।
আমার বর সেই হবিষ্যির স্বাদ এখনও ভুলতে পারেনি। যা সে বলেছে আমাকে, তার মতো করে তো আমি বলতে পারিনে—তার কথাগুলোই যতদূর মনে পড়ছে হুবহু লিখে দিলুম—
মনে পড়ে, বউঠাকরুণ হবিষ্যান্ন বেঁধে দিত, তাতে দিত সামান্য গাওয়া ঘি। ওই তিনদিন তার স্বাদে-গন্ধে মুগ্ধ হয়েছিলুম লোভীর মতো।।
আর একদিন আপনাদের রবি ঠাকুর আমাকে বললেন, বুঝলে ছোটবউ, ছেলেবেলায় আমি পান্তাভাত খেতে ভালোবাসতুম।
আর সেই পান্তার স্বাদে যেদিন যুক্ত হত নতুন বউঠানের আঙুলের স্পর্শ, অল্প একটু লঙ্কার আভাস দিয়ে, সেদিন আর কথা ছিল না।
শুধু কিন্তু হবিষ্যি আর পান্তার মধ্যেই আমার বরের মুগ্ধতা বন্দি হয়ে থাকল না।
তার মনের মধ্যে অন্য ঢেউ উঠল। একদিন আমার বর আর আমি একলা বেড়াতে বেরিয়েছি পদ্মার চরে।
বিকেলবেলা। আকাশ জুড়ে মেঘ করেছে। সেদিকে তাকিয়ে আপনাদের রবি ঠাকুর বললেন, নতুন বউঠানের চোখ দুটো এমনভাবে আমার মনের মধ্যে গাঁথা হয়ে আছে যে জ্বলজ্বল করতে থাকে, কিছুতেই ভুলতে পারি নে। যদি আঁকতে পারতুম তো বারবার তার চোখ দুটিকে আঁকতুম।
আসলে আমার বর তার নতুন বউঠানকে খুব বেশি ভালোবেসে ফেলেছিল খুব কাঁচা বয়েসে।
আর নতুন বউঠান?
বলতেই হবে সেকথা?
না, আমি বলতে চাইনে। আমি যদি লেখক হতুম বলতে পারতুম। যা বলা যায় না, বলতে নেই, তাও লেখকরা কেমন সুন্দর করে বলতে পারেন।
শুধু একটা কথা না বলে পারছি না—রবি ঠাকুর যখন সতেরো বছর বয়েসে হঠাৎ বিলেত চলে গেল, উনিশ বছরের নতুন বউঠান তখন কত যে কষ্ট পেয়েছিল, তা লিখে বোঝাতে পারব না।
আপনাদের রবি ঠাকুর কিন্তু অত কষ্ট পাননি। একথা আগেও বলেছিনা?
তিনি তো নতুন দেশে কত নতুন অভিজ্ঞতা আর মজার মধ্যে গেলেন। কয়েকটি মেয়ের সঙ্গে কমবেশি ভালোবাসাও তো হল। তখন কি নতুন বউঠানের কথা তাঁর মনে পড়েছিল? কী করছে, কেমন করে দিন কাটছে নতুন বউঠানের জোড়াসাঁকোর অবহেলায় অপমানে?
আমাকে নতুন বউঠান সম্পর্কে কত সময়ে কত কথাই তো বলেছেন আপনাদের রবি ঠাকুর। কিন্তু কোনও কোনও কথা আবার বলেননি। বেশ বুঝতে পারতুম বলতে চাইছেন না।
তিনি যা বলেছেন আমাকে, তার চেয়ে অনেক বেশি বলেননি। কতটা বলতে হয় আর কোথায় দাঁড়ি টানতে হয় তাঁর মতো আর কে জানে?
একদিন জিগ্যেস করেছিলুম—একদিনই শুধু—তুমি নতুন বউঠানকে বিলেত থেকে নিশ্চয় অনেক চিঠি লিখেছিলে। আর তিনি তো আমার মতো মুখ ছিলেন না যে তোমাকে চিঠি লিখতে ভয় পেতেন। একদিন দেখাবে তুমি আমাকে ওঁর লেখা একটা চিঠি?
আমার এ-প্রশ্নের সরাসরি কোনও উত্তর দিলেন না উনি। শুধু ওঁর ফরসা মুখটা আরও লাল হয়ে উঠল। কী জানি, হয়তো রেগে গেলেন আমি আলটপকা এভাবে কথা বলে ফেলেছি বলে। স্ত্রীর অধিকার তিনি আমাকে নিশ্চিত দিয়েছেন। কিন্তু এতটা নয়।।
দু-তিনদিন পরে উনি আমাকে বললেন, একটু মজা করেই বললেন বলে মনে হল, আসলে ওঁর মনের কথা যে ঠিক কী তা বুঝতে পারতুম না সব সময়ে, ওঁর মনের উপর অনেক ঢাকনা যে-কথা বলছিলুম, উনি বললেন, নতুন বউঠাকরুণকে লেখা আমার অনেক চিঠি ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। যাকে লিখছি সে ঠিকই বুঝত, তাকেই এসব চিঠিতে আভাসে ইঙ্গিতে অনেক কথা বলছি—আর কেউ বুঝত না।