যাইহোক, আমার তো মনে হয় বিহারীলালের ভালোবাসাই নতুন বউঠানকে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির নায়িকা করে তুলল। তখন কোথায় আমার বর রবি ঠাকুর? তিনি তখন নিতান্ত নাবালক। বিহারীলাল ভালোবাসতেন নতুন বউঠানকে। আর নতুন বউঠান? শুনেছি, বিহারীলালের ভালোবাসার কবিতা শুনে খুশি হয়ে নতুন বউঠান তাঁকে রান্না করে নানারকম খাওয়াতেন। মাঝেমধ্যে উপহারও দিতেন। নিজের হাতে একটি আসন বুনে তিনি নাকি বিহারীলালকে দেন। তাতে আমার বরের খুব হিংসে হয়েছিল।
আর আমার বর খুব দুঃখ পেত যখন নতুন বউঠান ওকে বলতেন, ঠাকুরপো, তুমি কোনওদিন বিহারীলালের মতো ভালো কবিতা লিখতে পারবে না। ঠিক বললুম কি? দুঃখ হত, আবার অভিমানও হত আমার বরের নতুন বউঠানের মুখে একথা শুনে।
আপনাদের রবি ঠাকুর একদিন আমাকে কিঞ্চিৎ মজা করেই বললেন, জানো ছোটবউ, তখন আমার বছর পনেরো বয়েস, নতুন বউঠানের মুখে ক্রমাগত বিহারীলালের প্রশংসা শুনতে শুনতে ঈর্ষান্বিত হয়ে আমি শেক্সপিয়রের ‘ম্যাকবেথ’ নাটকটাই অনুবাদ করে নতুন বউঠানকে শোনাতে লাগলেম। কিন্তু তাতে নতুন বউঠান এতটুকু ইমপ্রেসড হয়েছিল বলে তো মনে হয় না। বিহারীলালের কবিতাতেই তিনি মুগ্ধ হয়ে থাকলেন।
কিন্তু ছোটবউ, ম্যাকবেথ অনুবাদ করতে-করতে আমার মধ্যে একটা কাণ্ড ঘটল, বললেন আপনাদের রবি ঠাকুর।
কিছুক্ষণ কী ভাবলেন। হয়তো ভাবলেন আমি বুঝতে পারব না। উনি আবার বলতে লাগলেন–
ম্যাকবেথ নাটকেই আছে ‘হেকাট’ নামের এক ডাইনির প্রসঙ্গ। আসলে কিন্তু ওর নাম ‘হেকেটি’। হেকেটি বা হেকাট শুধু শেক্সপিয়রের ডাকিনি নয়। সে এক গ্রিক দেবী যে থাকে এক রহস্যময় অন্ধকারে। সে আসলে অন্ধকারের দেবী। তাকে দেখা বা বোঝা যায় না। শুধু অনুভব করা যায় তার আকর্ষণ। আমার মনে পড়ল নতুন বউঠানকে। হেকেটির মতোই নিঃসঙ্গ, হেকেটির মতোই অন্তরালবাসিনী। আমি আমার কবিতার খাতা মালতী পুঁথি-র পাতায় প্রবল আবেগে লিখতে লাগলেম, বারবার, হেকেট ঠাকরুণ, হেকেট ঠাকরুণ। কিছুদিনের মধ্যে আমি নতুন বউঠানকে হেকেটি বউঠান বলে ডাকতেও লাগলাম। তারপর শুধু ‘হে’ বলে।
আমি ‘হে’ বলে ডাকলে সে মুখে সাড়া দিত না।
শুধু আড়চোখে মৃদু হেসে তাকাত।
সেই তাকানো আমি ভুলতে পারিনি।
নতুন বউঠানের মধ্যে একটা দুষ্টুমি ছিল প্রথম থেকেই। ভারি মিষ্টি দুষ্টুমি, বললেন আমার স্বামী। আর বললেন, নতুন বউঠান চুপিচুপি একদিন বললে, ‘হে’ নামটা যেন কেউ জানতে না পারে। তোমার দেওয়া এই নামটি যেন তোমার কাছেই থাকে ঠাকুরপো।
সেদিন এর চেয়ে বেশি কিছু বলেননি আপনাদের রবি ঠাকুর।
নতুন বউঠান সম্পর্কে আমি যা জেনেছি, সবই আমার শোনা কথা।
নানা মুখের নানা কথা ক্রমে আমার মনের মধ্যে দানা বেঁধে একটা ছবি ফুটিয়ে তুলেছে।
ঠাকুরবাড়ির মেয়েমহলে নতুন বউঠান সম্পর্কে নানা কথা চলত।
নতুন বউঠানকে অনেকেই আড়ালে ‘মক্ষীরানি’ বলতেন।
নিজের কানে শুনেছি সেকথা।
০৪. আমি যে লেখক নই
আমি যে লেখক নই এবং এই লেখাটার উপর যে আমার বিন্দুমাত্র হাত নেই, সেটা নিশ্চয় আপনারা এতক্ষণে বুঝে গেছেন। এবং অনেক আগেই হয়তো লেখাটা পড়াই বন্ধ করে দিয়েছেন।
আবার অনেকে হয়তো আমার প্রতি দয়াপরবশ হয়ে কিংবা রবি ঠাকুর আর আমার ব্যক্তিগত জীবনের হাঁড়ি এই যে এইভাবে হাটে ভাঙছি আমি, সেই কারণেই লেখাটা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেননি।
যাঁরা এখনও আমার সঙ্গে আছেন, তা সে যে কারণেই হোক, তাঁদের জিগ্যেস করছি, মনে আছে কি আপনাদের এই লেখাতেই বেশ কিছু আগে আমি বলেছি, রবি ঠাকুর আমার একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি!
প্রশ্নটা খুবই সহজ—কেন রবি ঠাকুর, কেন তুমি বিয়ে করলে আমাকে?
সেই ‘কেন’র উত্তর আমার বর আমাকে দেয়নি।
দিতে পারেনি।
আমি লিখেছিলুম, সেই ‘কেন’-র উত্তর উঁকিঝুঁকি মারছিল ঠাকুরবাড়ির মেয়েমহলের টিপ্পনিতে, আড়চোখের চাউনিতে, নানারকম বাঁকা কথার চোরাস্রোতে।
ডুবুরি যেমন খুঁজে পায় সমুদ্রের অনেক নীচের মণিমুক্তো, তেমনি করে আমি পেয়েছি আমার সেই ‘কেন’-র উত্তর।
এই ‘কেন’-র উত্তর লুকিয়ে আছে রবি ঠাকুরের জীবনের একান্ত গোপন এক কাহিনির মধ্যে।
সেই গল্প আমি একটু একটু করে জোগাড় করেছি।
এই গল্পের মধ্যেই আমার বর রবি ঠাকুরের আর এক পরিচয়। চাঁদের উলটো পিঠ। একটা কথা, আমি কিন্তু এ-গল্প আমার স্বামীর নিন্দে করার জন্যে লিখছি না।
যা ঘটেছে তা অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা।
কোনও অন্যায় নেই এই কাহিনির মধ্যে।
আর আমরা তিনজনেই এই ঘটনার শিকার—আমার বর, তার নতুন বউঠান আর আমি।
১৮৭৮ সালে আমার বরকে বিলেত যেতে হল। তখন তার বয়েস সতেরো।
উনিশ বছরের নতুন বউঠান পড়ে থাকলেন জোড়াসাঁকোর বাড়িতে—অবহেলার মধ্যে।
কেউ তাঁর বন্ধু ছিল না এ-বাড়িতে। একমাত্র বন্ধু তাঁর দু-বছরের ছোট দেওর রবি ঠাকুর।
তাঁদের সম্পর্কটা কিন্তু শুধুমাত্র বউদি-দেওরের সম্পর্ক ছিল না। সতেরো বছরের রবি ঠাকুর, উনিশ বছরের কাদম্বরী, একজন কবি আর অন্যজন অসম্ভব একলা এক মেয়ে, যাঁকে কেউ ভালোবাসে না, সবাই যাঁকে বাজার সরকারের মেয়ে বলে নীচু চোখে দেখে আর যাঁর সঙ্গে স্বামী জ্যেতিরিন্দ্রনাথের সম্পর্কে তেমন কোনও মনের আঁট তৈরি হয়নি বলে আমার ধারণা।