কী সুন্দর কথা বলেন বলুন তো আমার রবি ঠাকুর। এরকম কথা আর কাউকে বলতে শুনিনি কখনও।
উনি কবি মানুষ। অনেক কিছুই কল্পনা করে নেন। যা ঘটে না তাও। যা অতি সাধারণ তার মধ্যেও অসাধারণ কিছু অনুভব করে গান লিখে ফেলতে পারেন।
এই যে উনি বললেন, নতুন বউঠান নাগপাশের মতো, বিলেত থেকে ফিরে উনি সেই নাগপাশে জড়িত বেষ্টিত হয়ে বসে রইলেন,“আমার মনে হচ্ছে এই সবই ওঁর কল্পনা।
নতুন বউঠান তো কোনওদিন আমার কাছেই আসেননি।
কখনও কাছে ডাকেননি।।
ভালোবেসে আদর করা, জড়িয়ে উড়িয়ে ধরা তো দূরের কথা। আমাদের পাড়াতে দুপুরবেলা ডাক দিয়ে কত খেলনাওলা যেত, কৃষ্ণনগরের পুতুল, রান্নাবাটি হাঁড়িকুড়ি কতসব—একটা খেলনাও তো কিনে দিতে পারতেন নতুন বউঠান।
কোনওদিন দেননি।
আমার জন্যে বিয়ের পরেই অনেক খেলনা পাঠিয়েছিলেন বাবামশায়।
ছেলের বিয়েতে উনি আসেননি বটে। কিন্তু আমার জন্যে খেলনা পাঠাতে ভোলেননি। আমার বিয়ের তিন মাসের মধ্যে আমি নতুন বউঠানকে যতটুকু বুঝতে পেরেছিলুম, ওই বয়েসে কী-ই বা বোধবুদ্ধি আমার—তবুও যতটুকু বুঝেছি, মনে হয়েছে তিনি একেবারেই খোলামেলা মানুষ নন। কেমন যেন নিজের মধ্যে সিঁধিয়ে-যাওয়া মানুষ।
আমার পরে মনে হয়েছে—পরে মানে যখন আমি ছেলেপিলের মা হলুম, রীতিমতো সংসারী হয়ে উঠলুম, তখন বুঝতে পারলুম নতুন বউঠানের পায়ের তলায় কোনও মাটি ছিল না।
এই সংসারে কোনওদিন উনি হালে পানি পাননি।
যদিও সংসারের পুরুষমহলে ওঁর হঠাৎ বেশ কদর হয়েছিল।
সেটাও অনেকটাই অবিশ্যি আমার স্বামীর জন্যেই।
স্বয়ং রবি ঠাকুর ওঁকে কতগুলি বই পরপর উৎসর্গ করলেন।
আর কী ভাষায় সেইসব উৎসর্গ!
স্পষ্ট করে বলছেন না কিন্তু নতুন বউঠানকে দিলুম।
’প্রকৃতির প্রতিশোধ’ উনি উৎসর্গ করেছেন শুধু এইকথা লিখে ‘তোমাকে দিলাম।’
তারপর ‘শৈশবসংগীত’ বেরোল। উনি উৎসর্গ করলেন নতুন বউঠানকেই। লিখেছেন ‘তোমাকেই দিলাম।’
এসব আমি আগে কিছুই বুঝিনি।
এসব যে একটা ভাববার ব্যাপার, তাই মনে আসেনি কখনও।
অনেক পরে সব বুঝলাম। তখন তো নতুন বউঠান নেই।
কিন্তু নেই বলি কী করে?
‘ভানুসিংহের পদাবলী’ যখন বেরোল তখন তো নতুন বউঠান চলে গেছেন।
কিন্তু সেই বইও উৎসর্গ করলেন ওঁকেই। কী বললেন? বললেন, ভানুসিংহের কবিতাগুলি ছাপাতে তুমিই তো অনুরোধ করেছিলে। তোমার সেই অনুরোধ তখন পালন করিনি। আজ সেই বই ছাপিয়েছি।
কিন্তু তুমি আর দেখতে পেলে না।
ছ’বছর পরে ‘মানসী’ প্রকাশিত হল।
উনি উৎসর্গপত্রে লিখেছেন—তব করে দিনু তুলি সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণের প্রকাশ। কার হাতে, স্পষ্ট করে বললেন না। আমার হাতেও তো হতে পারত।
‘মানসী’ যে বছর বেরোল সে-বছর আমাদের বিয়েরও সাত বছর হল।
কিন্তু তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণের প্রকাশ তিনি যাঁর হাতে তুলে দিলেন তিনি নতুন বউঠান—সবাই বুঝল আর আমি বুঝব না?
সাত বছর আগে নতুন বউঠান চলে গেছেন, তবু তিনিই তখনও আছেন ওঁর সমস্ত মনপ্রাণ জুড়ে।
আমি থেকেও নেই।
ঠিক মনে নেই, আরও বোধহয় বছর ছয়েক পরে ছাপা হল ওঁর বিখ্যাত কবিতার বই ‘চৈতালি’। আমি তখন ওঁর পাঁচ ছেলেমেয়ের মা।
আমি জানতুম, আর যাকেই দিন, ‘চৈতালি’ উনি আমাকে দেবেন না। আমি তো তখন শুধু অমুকের আর অমুকের আর অমুকের মা। আর বাড়ির কাজের লোক।
কিন্তু ‘চৈতালি’ যেই হাতে এল, বইটি কাকে উনি উৎসর্গ করলেন সেটিই সবথেকে আগে জানতে চাইল আমার চোখ।
বলিহারি মেয়েমানুষের মন।
এ কীরকম উৎসর্গ?
উনি লিখেছেন, তব ওষ্ঠ দশনদংশনে টুটে যাক পূৰ্ণফলগুলি! প্রথমে আমি সত্যি বলছি কিছু বুঝতে পারিনি।
ভাবলুম, ওঁকেই জিগ্যেস করি।
তারপর মনে হল, কেউ তো ওঁকে কিছু জিগ্যেস করছে না। সবাই তো একেবারে চুপ।
তার মানে, সবাই বুঝছে আর বুঝেই চুপ করে আছে।
সবাই যা বুঝছে, আমিই বা বুঝব না কেন?
’দশনদংশন’ ছাড়া আর তো কোনও শক্ত কথা নেই। দশন মানে তো দাঁত, সে তো আমি জানি। আর দংশন হল কামড়।
তার মানে যাকে উৎসর্গ করা হল তার দাঁতের কামড়, এই তো?
কী হবে সেই দাঁতের কামড়ে?
ভেঙে যাবে রসে ভরতি ফলগুলি।
সেই রসে ভরতি ফলগুলিই কি নয় ‘চৈতালি’র কবিতা?
তখনই মনে এল, একদিন উনি আমাকে বলেছিলেন, নতুন বউঠানকে হাসলে ভারি সুন্দর দেখাত।
ওঁর দাঁতগুলি ভারি সুন্দর ছিল তো!
আমি উৎসর্গের এই কথাগুলির দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেম। বুঝবার আর কিছু বাকি থাকল না আমার।
একসময়ে ঠাকুরবাড়িতে যে গানবাজনা, সাহিত্য নিয়ে আলোচনা, এই সব হত তার মাঝখানে ছিলেন আমার মেজোজা জ্ঞানদানন্দিনী। খুব দাপট ছিল তাঁর।
সব বদলে দিলেন ওঁর নতুন দাদার বন্ধু বিহারীলাল চক্রবর্তী।
উনি জোড়াসাঁকোর বাড়িতে এলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বন্ধু হিসেবে। এবং যাকে বলে, উড়ে এসে জুড়ে বসলেন।
বিহারীলাল ছিলেন খুব নামকরা কবি। নতুন বউঠান নাকি ওঁর কবিতা বিশেষ পছন্দ করতেন।
আর বিহারীলালও ক্রমে এ-বাড়িতে ঘনঘন আসতে শুরু করলেন নতুন বউঠানের জন্যেই।
নতুন বউঠানের উদ্দেশে কবিতা লিখতে লাগলেন। তাঁকে সেগুলি পড়ে শোনাতেন। শুনেছি, ভালোবাসার কবিতা।
বিহারীলাল চক্রবর্তীর মতো কবি যে-মেয়ের জন্যে কবিতা লেখেন, যে মেয়েকে সেইসব কবিতা পড়ে শোনাবার জন্যে আমাদের বাড়িতে আসেন, যে-মেয়ে ক্রমেই হয়ে ওঠে তাঁর প্রাণের মানুষ সেই মেয়ে ক্রমে এ-বাড়ির গানবাজনা, সাহিত্য, এসব নিয়ে আসরের প্রধান হয়ে তো উঠবেনই। আড়ালে সরে গেলেন জ্ঞানদানন্দিনী। তিনি তো চলেই গেলেন এ-বাড়ি থেকে। আমি বেশ বুঝতে পেরেছিলুম, নতুন বউঠানকে তিনি ঈর্ষা করতেন।