বই দিয়েছি জয় গোস্বামী, কবীর সুমন, ব্রাত্য বসুকে। ব্রাত্য বসুও মন্ত্রী হবার অনেক আগে থেকে আমার চেনা। উনি জানেন–আমি এক রিকশা চালক লেখক। আমাকে নিয়ে উনি আর তথাগত দত্ত কলকাতা টিভির জন্য একটা প্রোগ্রামও শু্যট করেছিলেন।
এমনিভাবে বর্তমান সরকারের প্রভাবশালী কত লোককে যে বই দিয়েছি গুণে বলতে পারবো না। ভেবেছি–কেউ যদি বইটা পড়ে আমার জন্য কিছু না করে পারবে না। কিইবা এমন করবে? শুধু মুখ্যমন্ত্রীকে একটা ফোন, একটা ছোট্ট অনুরোধ। বইগুলোর কী হয়েছে তা কে জানে? আর আমার জীবন? যা ছিল তাই। পশ্চিমবঙ্গে পরিবর্তন এসে গেছে আমি রয়েছি অপরিবর্তিত।
বিধায়ক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়–ওনার পত্রিকা ‘অঙ্গীকারে’ আমি দুবার লেখা দিয়েছি। আনন্দবাজার পত্রিকার কার্টিংও দিয়েছি ওনাকে। হয়তো পড়েছেন লেখাটা। কিন্তু কিছু ভেবেছেন আমার জন্যও প্রমাণ পাইনি।
নিম্নবর্ণের কোনো কেউ উচ্চ হয়ে উঠুক তারা চায় না। তারা এমন কিছু করতে মনের সায় পায় না যাতে তাদের উচ্চতা কোনো প্রতিস্পর্ধার সামনে পড়ে। এটা যে তারা সব সময় সচেতনভাবে করে তা নয়–। অবচেতন মন যান্ত্রিকভাবে অনেক সময় তাদের দিয়ে এসব করিয়ে নেয় যা তারা জানতেও পারে না।
ধরা যাক–শহর কলকাতার কোনো নামি পত্রিকায় দশজন অনামি লেখক একটা করে গল্প জমা দিয়েছে। ওই দশজনের নয়জন স্বাভাবিক কারণেই চ্চাটার্জি মুখার্জি, ব্যানার্জি, চক্রবর্তী, সেনগুপ্ত, দাশগুপ্ত, ঘোষ, বোস, মিত্তির হবে। একজন হবে ব্যাপারী বা বাগ বা সর্দার। লেখা বাছাই করার সময় পাঠের জন্য, পত্রিকার উচ্চবর্ণ সম্পাদক ওই নয় জনের মধ্য থেকে এক দুই তিন জনকে পছন্দের তালিকায় রাখবেন। ভুলেও ব্যপারী, বাগ, সর্দারের লেখা ছুঁয়েও দেখবেন না। পড়া তো দূরের ব্যাপার, ছাপা তো আরও দূরত্বের ব্যাপার–। চাকরি বাকরি বা যে-কোনো সুযোগ সুবিধা পাইয়ে দেবার ক্ষেত্রে এই একই নিয়ম চলছে।
এই নিয়মের কারণে আমি ঝাড় খেয়ে গেছি। যদি আমার জন্ম দলিত পরিবারে না হতো, যদি আমার পদবি ব্যাপারী না হয়ে ব্যানার্জি হতো, আমার জন্য তদবির করার লোক জুটে যেত, কারণ আমি জন্মজনিত কারণে এই দেশে অপরাধী।
এই কিছুদিন আগে খবরের কাগজে একটা খবর পড়ে মনটা আনন্দে নেচে উঠেছিল। কী?, একটি পথশিশু, বয়স বছর চৌদ্দ পনের, যে চুরি টুরি করত। পুলিশ তাকে ধরে। কিন্তু জেলে নিয়ে যায়নি। নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে দিয়েছে এক হোস্টেলে সে যেখানে থাকবে লেখা-পড়া শিখবে, মানুষ হবে।
পুলিশ শুধু খুন, ডাকাতি, ধর্ষণ করে না তার একটা অন্য রূপ আছে, একটা মানবিক মুখ আছে। জেনে বড় ভালো লেগেছিল, সেই ভালো লাগা শুকিয়ে এল একটু পরে–ভাবতে লাগলাম যে দেশের পথে পথে লক্ষ লক্ষ বালক কিশোর পড়ে আছে কেউ তাদের দিকে ফিরেও তাকায় না, ওই একজনের প্রতি এত সদয় কেন ব্যাপারটা কী?তখন দেখলাম–ওই ছেলেটার পদবি চক্রবর্তী। আর কিছু বলার দরকার নেই। আমার সব কথার জবাব গোপন আছে চক্রবর্তী–চক্র ঘিরে।
পুলিশ অফিসার কী খুব সচেতনভাবে সদয় হয়ে উঠেছিলেন উচ্চবর্ণ সন্তানের এমন হীন জীবন-যাপন দেখে। না তা নয়। অন্তরের অন্তঃস্থলে একটা মোচড় দিয়েছিল নিজের অজ্ঞাতে। আহা রে বাছা! যে মোচড় কোনো নমো বাগদির বাচ্চা দেখে আসে না। ওদের কালো কদাকার মুখ দেখে দয়া দৌড়ে পালায়।
আর সেই কালো কালো না খাওয়া ভূত সদৃশ্য মানুষ যখন ভালো খাওয়া ভালো পরা উচ্চবর্ণ ভদ্রলোকদের উচ্চতাকে হারিয়ে দেবার স্পর্ধা দেখায় তখন তাদের রাগে শরীর জ্বলে। মনে পড়ে সেই নিম্নবর্ণের বাচ্চা বুধিয়ার কথা। বারো বছরের বালক বুধিয়া ~ যে দৌড়েছিল পৃথিবীর সবচেয়ে লম্বা রেস ম্যারাথন। যে রেস শেষ করতে বড় বড় দৌড় বীরের দম বের হয়ে যায়। অনেককে হারিয়ে মাড়িয়ে সেই দৌড় শেষ করেছিল বুধিয়া। তার ছোট্ট পায়ের নিচে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গিয়েছিল বর্ণবাদের অহঙ্কার দর্প দম্ভ।
তখন রে রে করে তার দিকে ধেয়ে গিয়েছিল অসংখ্য মানব-দরদীর মুখোশ আটা ব্যক্তি-সংগঠন। সমস্বরে শেয়ালের মতো হুঙ্কার তুলেছিল এ অন্যায়, এ অতি অসামাজিক। এতটুকু বাচ্চাকে এত পথ দৌড় করানো অনুচিত।
বুধিয়ার মা শিশু বুধিয়াকে দুবেলা খেতে দিতে পারত না, হয়তো না খেয়েই সে মরে যেত। তখন কেউ তাকে একমুঠো চাল দিয়ে সাহায্য করেনি। সে আর কী হতো! এমন তো হাজার হাজার মরে। সে মৃত্যু অতি সাধারণ ব্যাপার এবং কোনোমতেই অন্যায় অমানবিক নয়।
বুধিয়ার মা তখন তাকে বিক্রি করে দেয়। বালক বুধিয়াকে মাত্র পাঁচ টাকায় কিনে নেয় বিরিঞ্চি দাস। সে বুধিয়ার ছোট্ট পা দুটো গড়ে তোলে বর্ণপ্রভুদের মুখে লাথি মারার উপযুক্ত করে। এই অপরাধে গুলি করে মেরে ফেলা হয় প্রশিক্ষক বিরিঞ্চি দাসকে। আর নানা আইনি প্রতিবন্ধকতা দিয়ে বুধিয়ার পায়ে পরিয়ে দেয়া হয় বেড়ি। আর সে দৌড়তে পারবে না। পারবে তখন, যখন তার বয়স হবে আঠারো বছর। এতদিন ফেলে রাখলে লোহাতেও মরচে ধরে যায়। কে আর বুধিয়াকে ঘসে মেজে ধারালো করে রাখবে। বিরিঞ্চি দাস তো নেই। হারিয়ে যাবে ‘বিস্ময় বালক’ বুধিয়া। চিন্তামুক্ত হয়ে গেছে বর্ণপ্রভুরা। কেউ তাদের উচ্চতাকে চ্যালেঞ্জ করবে না।