এখানকার মাটির নিচে আছে লোহা, তামা, সিসা, ডলোমাইট বক্সাইট আরও কত খনিজ সম্পদ। মেহনতি মজদুরের অভাবে সেসব যথাযথ সংগ্রহ সম্ভব হয় না। আদিবাসী মানুষরা সাধারণতঃ এসব কাজে পারদর্শী নয়। তারা শ্রমজীবনের উৎপাদনমুখী শৃঙ্খলাও মেনে চলে না। তাদের দিয়ে এসব কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন করা যায় না। রিফিউজিদের এখানে নিয়ে এলে এই সমস্যা মিটে যায়। এখানকার জমি তো এমন নয় যে শুধু চাষবাসে বছর চলে যাবে। তখন পেট চালাতে হলে অন্যকাজ না করে উপায় থাকবে না। এই সব দুষ্ট পরিকল্পনা মাথায় রেখে গঠিত হয়েছে দণ্ডকারণ্য পুনর্বাসন প্রকল্প।
এই পাটিগণিতের হিসাবে একদিন ক্যাম্পের অফিস ঘরের নোটিস বোর্ডে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল একটা নোটিশ। সেই নোটিশের যা বক্তব্য একজন ঢেড়া পিটিয়ে ক্যাম্পের মধ্যে ঘুরে ঘুরে সবাইকে জানিয়েও এসেছিল। এতদ্বারা মহামান্য ভারত সরকারের পুনর্বাসন বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো যাচ্ছে যে শিরোমণিপুর ক্যাম্পের সমস্ত রিফিউজিদের পুনর্বাসনের নিমিত্তেদণ্ডকারণ্য ডেভেলাপমেন্ট অথরিটির অধীনে রিফিউজি প্রেরণ শীঘ্রই শুরু করা হবে। যে আগে নাম নথিভুক্ত করাবে সে আগে যাবে। আপনাদের নিকট আবেদন সত্বর নাম নথিভুক্ত করান।
দণ্ডকারণ্য! পুনর্বাসন! ক্যাম্পের যারা সামান্য অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন, রামায়ণ মহাভারত পড়তে পারে, দণ্ডকারণ্যের নামে বুক হিমশীতল হয়ে গেল তাদের। কোথায় পুনর্বাসন?–এ-তো পুনঃ নির্বাসন। দণ্ডকারণ্য, সে যে এক মহাঅরণ্যের নাম। মহাকবি বাল্মীকি তার মহাকাব্যে লিখেছেন অতীব বিপদ সঙ্কুল সে স্থানের বিশদ বর্ণনা। সেখানে এমন ঘনঘোর অরণ্য যে দৃষ্টি চলে। সে বনে ঘুরে বেড়ায় নরমাংস ভক্ষক রাক্ষস খোক্কসের দলবল। একবার মানুষকে নাগালে পেলে আর কথা নেই, ধরে কচক করে চিবিয়ে খেয়ে নেয়। ওই বনে গিয়ে নররূপী নারায়ণ রামচন্দ্র কী ভীষণ বিপদে না পড়েছিলেন, আর আমরাতো সামান্য মানুষ।
ভয়তাড়িত এইসব সরল সোজা মানুষের ভয়ভীতিকে মূলধন করে আবার রাজনীতির আসর গরম করতে পথে নেমে পড়ল কমিউনিস্ট নামধারী নেতারা। সেই ১৯৫১-৫২ সালে আন্দামান পুনর্বাসন প্রকল্প বানচাল করবার পর এই ৬/৭ বছর আর বানচাল করার মতো কোন কাজ ছিল না। আবার একটা সুযোগ এসেছে। সুদূর কলকাতা মহানগর থেকে বাঁকুড়ার শালবনে-শিরোমণিপুর ক্যাম্পে ছুটে গেলেন এক নেতা। মাইকে মুখ রেখে তারস্বরে চেঁচিয়ে তিনি মানুষকে খুঁসলানি দিয়ে বেড়াতে লাগলেন “আপনারা কেউ যাবেন না দণ্ডকারণ্য। কেন যাবেন! আপনারা এই বাংলার মানুষ। আপনাদের বাংলাতে পুনর্বাসনের অধিকার আছে। আর তাই আপনারা পাবেন। আমি দিল্লি যাব। গিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে বলবো বাংলার মানুষকে বাংলার বাইরে পাঠানো চলবে না। ভয় পাবেন না, হতাশ হবেন না, আমরা আপনাদের পিছনে আছি।”
সরকারি দপ্তর থেকে নির্দিষ্ট দিনক্ষণ জানিয়ে নাম নথিভুক্ত করার যে আবেদন জানানো হয়েছিল, সেদিন এক অফিসার মোটা একটা খাতা নিয়ে অফিস ঘরে বসেছিলেন, কিন্তু নাম লেখাতে বিশেষ কেউ এল না। পরের দিন লোক নিতে এসে বেশ কটা ট্রাক খালি ফিরে গেল। কারণ, যারা যাবার জন্য নাম দিয়েছিল শেষ পর্যন্ত তাদেরও বড় একটা অংশ ট্রাকে উঠল না।
এইভাবে প্রায় বছর খানেক ধরে বারবার অফিসঘরে নোটিশ দেওয়া হল। বারবার ব্যর্থ হল সরকারি প্রয়াস। অবশেষে একদিন সকালে যে ট্রাকগুলো এসেছে সেগুলো আর খালি গেল না। অফিসের সব চেয়ার টেবিল আলমারি তোলা হচ্ছে তাতে। অফিসাররা সবাইফিরে যাচ্ছেবিষ্ণুপরের হেড অফিসে। বলে যাচ্ছে তারা যদি কেউ দণ্ডকারণ্য যেতে ইচ্ছুক হয় সে যেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হেড অফিসে গিয়ে নাম লেখায়। আগামী সাতদিনের জন্য এই সুযোগ থাকবে।
কাজেই অমানবিক ভারত সরকার রিফিউজিদের দায়দায়িত্ব দুম করে কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে সেটা বোধহয় বলা চলে না। বার বার রিফিউজিদের সময় দেওয়া হয়েছে। সতর্ক করা হয়েছে, “এই সব ভণ্ড কপটাচারী কমিউনিস্টদের প্ররোচনায় ভুলবেন না। এরা আপনাদের ভুল বোঝাচ্ছে।” যখন মানুষ সে কথায় কর্ণপাত করেনি, বাধ্য হয়ে সরকারের যা করবার ছিল তা করে দিয়েছে।
এবার কী হবে আমাদের, কী হবে এরপর? রিফিউজিদের আকুল প্রশ্নের জবাবে বলে নেতারা–এবার আন্দোলন হবে। ঘোর আন্দোলন। এমন একখানা আন্দোলন করব যে সরকার আমাদের ন্যায্য দাবি মেনে না নিয়ে পালাবার পথ পাবে না। বাংলায় পুনর্বাসন দেবে না! দণ্ডকারণ্য পাঠাবে। মামদোবাজি নাকি?
বিষ্ণুপুর শহর থেকে যে বাস রাস্তাটা সোজা কামারপুকুর চলে গেছে সেই রাস্তার ধারে আরও তিনটে রিফিউজি ক্যাম্প ছিল। বাসুদেবপুর ১.২.৩ নাম্বার ক্যাম্প। ওই তিন ক্যাম্প আর শিরোমণিপুর, চার ক্যাম্পের প্রায় হাজার পনের কুড়ি মানুষ এবার প্রস্তুত হল উক্ত নেতার নেতৃত্ব আন্দোলনে ঝাপাবার জন্যে। প্রথম দফায় আন্দোলন শুরু হল অনশন ধর্মঘটের মধ্য দিয়ে। একটা গাছের নিচে, লোক চলাচলের পাকা রাস্তার ধারে ত্রিপল খাঁটিয়ে প্রায় শ’খানেক লোক বসে পড়ল আমরণ অনশনে। রিফিউজিদের পক্ষে তখন ছিল এটা সব চেয়ে সহজতম একটা আন্দোলন। সরকারি গুদাম থেকে শেষ খেপ যে চালডাল ডোল দেওয়া হয়েছিল সেটা মাস তিনেক আগের। বলা চলে যা প্রায় এক বিস্তৃত অতীতের ঘটনা। এখানকার মানুষগুলো যে জাতি গোষ্ঠি সম্প্রদায়ের মানুষ সেই নমঃ পোঁদ জেলেদের সংসারে তো চিরকালের অভাব দাপাদাপি করে বেড়ায়। এদের সবার সঞ্চয় বলতে শুধুই হা হুতাশ আর দীর্ঘশ্বাস। এদেশে যখন তারা পালিয়ে আসে হাতের মুঠোয় শূন্যতা ছাড়া আর কিছু তো ধরা ছিল না। পেট প্রতিপালন হচ্ছিল সরকারি ডোলের আনুকূল্যে। ফলে সেই শেষ পাওয়া ডোলের চালটুকু ফুরিয়ে যাবার পর ঘরে ঘরে শুরু হয়ে গেছে অরন্ধন-উপবাস-অনাহার। এখন আর কারও কোন আলাদা ভাবে প্রস্তুতি নেবার প্রয়োজন ছিল না। শুধু গাছতলার ত্রিপলের ছাউনির নিচে গিয়ে বসে পড়লেই আমরণ অনশন।