পছন্দসই, প্রিয় একটা জায়গা বেছে নিন। আরামদায়ক কোনো চেয়ারে বা বিছানার ওপর বসুন। নিচের দিকে পা ঝুলিয়ে বা পদ্মাসনেও বসতে পারেন। জামা কাপড় ঢিলে-ঢালা হওয়া দরকার। নিরিবিলি, শান্ত, ঠাণ্ডা পরিবেশ হলে ভালো হয়। হাত দুটো শিথিল অবস্থায় ফেলে রাখুন কোলের ওপর। মাথাটা সিধে রাখুন, এদিক ওদিক যেন হেলে না পড়ে। এবার স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে সচেতনতার সাথে ঢিল করার জন্যে প্রথমে শরীরের একটা অংশ তারপর আরেকটা অংশের ওপর গভীর মনোযোগ আরোপ করুন। শুরু করুন আপনার বাঁ পায়ের তলা থেকে, তারপর বাঁ পা, তারপর ডান পায়ের তলা-এইভাবে, যতোক্ষণ না আপনি গলা, মুখ, চোখ এবং সবশেষে খুলিতে না। পৌঁছান। এটা প্রথমবার অনুশীলন করার সময় কি রকম শক্ত আর টান টান ছিলো আপনার শরীর উপলব্ধি করে অবাক হয়ে যাবেন আপনি।
এবার যে-কোনো একটা কিছুর ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করুন। যে কোনো জিনিস হলেই চলবে, সিলিঙের একটা দাগ বা দেয়ালের পেরেক–যা খুশি। নাক বরাবর তাকালে দৃষ্টিটা যেখানে পড়ে সেখান থেকে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি ওপরদিকে তাকাতে হবে। আপনাকে। পেরেক বা দাগ যাই হোক, সেটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকুন, যততক্ষণ না চোখের পাতা একটু ভারি ঠেকে, তারপর ওগুলোকে নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে যেতে দিন। এবার পঞ্চাশ থেকে নিচের দিকে গুণতে গুণতে নামুন, এক পর্যন্ত। এই রুটিন পাঁচ দিন মেনে চলুন। তারপর পঁচিশ থেকে এক পর্যন্ত, পাঁচ দিন। তারপর দশ থেকে এক পর্যন্ত, পাঁচ দিন। তারপর পাঁচ থেকে এক, পাঁচ দিন। এই পদ্ধতিতে ধ্যানমগ্ন হওয়ার চেষ্টা প্রতিদিন দু-তিনবার চালিয়ে যান, প্রতিবার দশ-পনেরো মিনিট ব্যয় করুন। নিজেকে সাজেশন দেয়ার কথা মনে আছে তো? এক্ষেত্রেও সেগুলো কাজে লাগাতে ভুলবেন না।
আলফায় পৌঁছুনো তো শিখে গেলেন, কিন্তু তারপর কি? ওখানে পৌঁছে নিজেকে সাজেশন দেয়া ছাড়া আর কি করবেন আপনি?
একেবারে শুরু থেকেই, ধ্যানমগ্ন অবস্থায় প্রথম যেবার পৌঁছলেন তখন থেকেই, মানস- চোখে ছবি দেখা অভ্যেস করুন। মানস- চোখে ছবি দেখাটা যতো ভালো ভাবে শিখতে পারবেন আপনি, মনকে নিয়ন্ত্রণ করে সাফল্য অর্জন ততোই আপনার পক্ষে সহজ হয়ে উঠবে।
এ-ব্যাপারে প্রথম কাজ হলো, চাক্ষুষ করার জন্যে একটা উপকরণ তৈরি করা। উপকরণ মানে একটা স্ক্রীন, বা পর্দা। সাদা হলেই ভালো হয়, কারণ সাদার ওপরেই ছবি ফোটে ভালো। বড়সড় সিনেমার মতো পর্দা হওয়া উচিত, তবে আবার এতো বড় যেন না হয় যেটা মনের দৃষ্টির সবটুকু জুড়ে থাকে। পর্দাটাকে চোখের পাতার কাছাকাছি কল্পনা না করে কল্পনা করুন আপনার কাছ থেকে ছ’ ফিট সামনে। মনোনিবেশের জন্যে যা আপনি নির্বাচন করবেন, সেটার ছবি এই পর্দায় দেখতে হবে আপনাকে। পরে এই পর্দা আরো অনেক কাজে ব্যবহার করা হবে।
মনে এই পর্দা তৈরি করা হয়ে গেলে, এবার ওটার গায়ে সাধারণ, পরিচিত কিছু একটা ছবি ফুটিয়ে তুলুন। সেটা একটা কলা হতে পারে, একটা আপেল বা কমলালেবু হতে পারে। প্রতিবার ধ্যানমগ্ন অবস্থায় পৌঁছে এই ছবি ফুটিয়ে তুলবেন আপনি। একবার এটা, একবার ওটা না করে একটা জিনিসেরই ছবি দেখবেন, যদি বদলাতে চান তাহলে পরেরবার ধ্যানমগ্ন অবস্থায় বদলাবেন। পর্দা সম্পর্কে একটা কথা। কারো কারো জন্য এটা তৈরি করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়াতে পারে। তারা ইচ্ছে করলে চোখ বন্ধ করলে যা দেখতে পান সেটাকেই একটা পর্দা বলে মনে করতে পারেন।
যেনতেন ভাবে একটা ছবি ফুটিয়ে তুললে চলবে না। গভীর মনোযোগ আর আন্তরিকতার সাথে ওটাকে ফুটিয়ে তুলুন, যাতে আরো, আরো বাস্তব হয়ে ওঠে। ওটার যেন তিনটে দিকই পরিষ্কার দেখতে পান আপনি, রঙ এবং সমস্ত খুটিনাটি বৈশিষ্ট্য সহ। শুধু ওটার কথাই ভাবুন।
মানুষের চিন্তাকে তুলনা করা হয় মাতাল বানরের সাথে। লাফ-ঝাঁপ দিয়ে এখান। থেকে ওখানে চলে যাচ্ছে, মতিগতির কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। মাঝে মধ্যে আমাদের জন্যে অত্যন্ত সূক্ষ্ম কাজ করলেও, এই ব্রেনের ওপর আমরা কতো কম নিয়ন্ত্রণ রাখি ভাবতে গেলে আশ্চর্য হতে হয়। এ বড় শক্তিশালী, এতোই শক্তিশালী যে একে নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে সমূহ বিপদ, শত্রুর মতো আচরণ করে বসবে।
শত্রু হলেও, ব্রেনের একটা স্বভাব হলো, কেউ যদি তাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে, তার একেবারে কেনা গোলাম বনে যায়। একবার যদি আমরা মনকে ট্রেনিং দিয়ে নিতে পারি, আমাদের জন্যে আশ্চর্য সব কাজ করে দিয়ে সে তাক লাগিয়ে দেবে। অপেক্ষা করুন, একটু পরেই দেখতে পাবেন।
ইতিমধ্যে, সহজ সরল যে অনুশীলনগুলো চর্চা করার জন্যে দেয়া হলো, আপাততঃ তাই নিয়ে ধৈর্য ধরুন। একাগ্রতার সাথে মনটাকে ব্যবহার করে ব্রেনকে আলফা লেভেলে যাবার ট্রেনিং দিন। লেভেলে গিয়ে সাজেশন দিন নিজেকে। মনের পর্দায় ছবি ফুটিয়ে তোলার দক্ষতা অর্জন করুন। প্রথম দিকে নানা রকম বাজে চিন্তা নাক গলাবার চেষ্টা চালাবে, সেজন্যে অধৈর্য বা উত্তেজিত হবেন না। শান্ত ভাবে ওগুলোকে মন থেকে সরিয়ে ফেলুন, ফিরে আসুন নিজের কাজে। অস্বস্তি, বা উত্তেজনা বোধ করলে আপনার ধ্যান ভেঙে যাবে, উঠে আসবেন বিটা লেভেলে।
এই হলো ধ্যান, যা সারা দুনিয়ায় ব্যাপক ভাবে চর্চা করা হয়। আপনি যদি আর কিছু না, শুধু ধ্যান করেন, তাহলে উপভোগ করবেন, উইলিয়াম ওঅর্ডসওয়ার্থ যেটাকে বলেছেন, ‘এ হ্যাপি স্টিলনেস অভ মাইণ্ড’। অন্তরের অন্তস্তল পর্যন্ত গভীর এক শান্তিতে ছেয়ে যাবে। এরপর, ধ্যানের আরো যতো গভীরে প্রবেশ করবেন, ততোই আনন্দময় আর রোমাঞ্চকর হয়ে উঠবে আপনার অভিজ্ঞতা। রোজ তিনবেলা কোর্মা পোলাও খেলে ওগুলোর স্বাদ যেমন আর আগের মতো পাওয়া যায় না তেমনি আপনার এই অভিজ্ঞতা থেকেও রোমাঞ্চের মাত্রা একটু একটু করে কমতে শুরু করবে। এটা ঘটবে এই অভিজ্ঞতায় আপনি অভ্যস্ত হয়ে উঠবেন বলে, কি অনুভব করবেন তা আগে থেকে জানা থাকলে সেটা গভীর, গাঢ়ভাবে অনুভব করা যায় না। এই কাণ্ড ঘটতে শুরু করলে অনেকেই চর্চা করা ছেড়ে দেয়। কিন্তু আপনাকে বুঝতে হবে, ধ্যানমগ্নতা স্বয়ং একটা গন্তব্য নয়। আপনার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যাত্রাপথে ওটা একটা পদক্ষেপ মাত্র। তাও, প্রথম পদক্ষেপ। কাজেই এক পা এগিয়ে হাল ছেড়ে দিলে মস্ত ভুল করবেন। আপনি। অনেকে ছেড়ে দিক, আপনি ছাড়বেন না দয়া করে।