এসব যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করার সময়, ছাত্র-ছাত্রীরা পরামর্শদাতার অভাব বোধ করে। সাধারণ লোক বলে মনের ভেতর মন আছে, কখনো বা তার পরিচয় দেয়া হয় এই বলে–’শান্ত নিচু একটা কণ্ঠস্বর’। তারা এই শান্ত নিচু কণ্ঠস্বরের পরামর্শ চায়। তারা অবশ্য এটাকে নিচু কণ্ঠস্বর বলে না, তাদের কাছে ওটা অত্যন্ত জোরালো একটা কণ্ঠস্বর হিসেবে পরিচিত। এবং ওই কণ্ঠস্বর একটা নয়, দুটো। ল্যাবরেটরীতে দু’জন পরামর্শদাতা নেয় ওরা। একজন পুরুষ, আরেকজন মহিলা। ওদেরকে আগেই বলে দেয়া হয় ধ্যানমগ্ন হবার পর নিজের ল্যাবরেটরীতে দু’জন পরামর্শদাতা নেবে তারা, কাজেই কাকে কাকে নেবে না নেবে সে-ব্যাপারে আগেই চিন্তা-ভাবনা করে রাখার সুযোগ থাকে তাদের।
এক ছাত্র, পরামর্শদাতা হিসেবে একবার চেয়ে বসলো খোদ আলবার্ট আইনস্টাইনকে। কিন্তু পেলো কাকে জানেন? একজন ভাঁড়কে। লোকটার মুখ ছিলো রঙ করা। নাকের জায়গায় ছিলো গোলাপি রঙের একটা পিং পং বল। যদিও, কার্যক্ষেত্রে, দেখা গেল, যুক্তিসঙ্গত এবং তথ্যমূলক উপদেশ দেয়ার ব্যাপারে তার জুড়ি মেলা ভার।
আরেকজন ছাত্র, তার নাম স্যাম মেরিল। এই ছাত্রটি নিউ টাইমস পত্রিকায় মন নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে একটা প্রবন্ধ লিখেছিল। মজার ব্যাপার, সে তার ল্যাবরেটরীতে পরামর্শদাতা হিসেবে ঠিক যাদেরকে চেয়েছিল, পেয়েছিলও তাদেরকেই।
ছাত্রটি তার ল্যাবরেটরী বানিয়েছিল বিখ্যাত সাবমেরিন ‘নটিলাস’-কে। এবার মেরিলের নিজের ভাষায় শুনুন, ছোটো একজন মানুষ, পরনে জানু পর্যন্ত ঢিলা লম্বা পায়জামা আর সিল্কের শার্ট, উদয় হলো ডিকমপ্রেশন চেম্বার থেকে। রোগা-পাতলা মানুষ, হরিণের মতো মায়াভরা চোখ কোটরে একেবারে ভেতরে সেধিয়ে আছে। দেখেই চিনতে পারলাম, আমার পরামর্শদাতা আর কেউ নন, স্বয়ং উইলিয়াম শেক্সপিয়ার। হাত নেড়ে আমি বললাম, হাই! কিন্তু উত্তর করলেন না তিনি। শরীর হীন একটা কণ্ঠস্বর থেকে ঘোষণা বেরিয়ে এলো, আমরা তীরে যাচ্ছি। আমি আর উইল একটা হ্যাঁচওয়ে থেকে লাফ দিয়ে পড়লাম নির্জন সৈকতে। ওখানেই দেখলাম আমার দ্বিতীয় পরামর্শদাতাকে। পরামর্শদাতা নয়, দাত্রী। উনি আর কেউ নন, সোফিয়া
লরেন। সবেমাত্র তিনি সাঁতার কেটে তীরে উঠেছেন, তাঁর সুতী টি-শার্ট চামড়ার সাথে একেবারে সেটে আছে। প্রথমে তিনিও আমাকে কোনো পাত্তা দিলেন না, কিন্তু শেক্সপিয়ারকে দেখতে পেয়ে আনন্দে একেবারে আত্মহারা হয়ে উঠলেন। তাঁরা করমর্দন করলেন, কুশলাদি বিনিময় করলেন, তারপর দুজনেই পড়ে গেলেন বালির ওপর। ওখানে তাঁরা ছটফট করতে লাগলেন, ঘোঁৎ ঘোঁৎ আওয়াজ বেরিয়ে আসতে লাগলো তাঁদের নাক-মুখ থেকে।’
পরদিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করতে হবে। স্যাম মেরিলের ওরিয়েন্টো লজিস্ট তাকে ফ্লোরিডার এক বাষট্টি বছরের বুড়ির নাম বললো। দুই পরামর্শদাতা, যাঁরা নিজেদেরকে নিয়েই ব্যস্ত, খেলাচ্ছলে একবার পরীক্ষা করলেন বুড়িকে, তারপর নিজেদের কাজে চলে গেলেন।
পরামর্শদাতারা তাহলে কি পরামর্শ না দিয়েই চলে গেলেন? না। মেরিল দেখলো, মহিলার পেট বলে কিছু নেই, সম্পূর্ণটাই গায়েব হয়ে গেছে। তার জায়গায় লালচে রঙের এক প্রস্থ নাড়ি দেখা যাচ্ছে, ঠিক যেন নিওন বাতি, বিপদ সংকেতের মতো বারবার জ্বলছে আর নিভছে। পরে মেরিল তার ওরিয়েন্টোলজিস্টের কাছ থেকে জানলো, বৃদ্ধা মহিলা নাড়িতে তীব্র জ্বালা নিয়ে হাসপাতালে রয়েছেন।
মনকে যারা নিয়ন্ত্রণ করা শিখবেন তাঁদের কাছে এই পরামর্শদাতারা অত্যন্ত বাস্তব হয়ে উঠতে পারে। আসলে, কারা এরা? এর সঠিক উত্তর এখনো জানা সম্ভব হয়নি। হয়ত আদর্শ কল্পনার ফসল-অলীক উদ্ভাবন। হয়ত মনের ভেতর যে মন বা অন্তরের ভেতর যে কণ্ঠস্বর (ইনার ভয়েস) আছে তারই মূর্তি। কিংবা আত্মারই প্রতিচ্ছবি। অথবা অন্য কিছু। শুধু জানা গেছে যে পরামর্শদাতাদের সাথে পরিচয় এবং কাজ করতে শেখার পর, ওদের সাথে সম্পর্কটা হয়ে ওঠে সম্মানজনক। অচিরেই প্রমাণ হয়ে যায় এই সম্পর্ক একটা অমূল্য সম্পদ।
খ্রীষ্টের চারশো বছরেরও আগে, গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিসের একজন পরামর্শদাতা ছিলো। এই পরামর্শদাতার সাথে মন-নিয়ন্ত্রণ চর্চাকারীদের পরামর্শদাতার কিছু অমিল আছে। সক্রেটিসের পরামর্শদাতা তার উপদেশ শুধু সাবধান করে দেয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছিল। প্লেটোর কথা অনুযায়ী সক্রেটিস বলেছেন, সেই ছোটো বেলা থেকেই আধা-স্বর্গীয় একজনের অস্তিত্ব আমি অনুভব করে আসছি, যার কণ্ঠস্বর আমাকে মাঝে মধ্যেই নির্দিষ্ট কোনো কাজ করতে নিষেধ করে। কিন্তু আমাকে কি করতে হবে, সে নির্দেশ তার কাছ থেকে কখনোই আমি পাই না।
আরেকজন লেখক, জেনোফন (XENOPHON) সক্রেটিসের একটা উদ্ধৃতি তুলে দিয়েছেন। সক্রেটিস বলেছেন, আজ পর্যন্ত এই কণ্ঠস্বরের সাবধানবাণী কখনো ভুল প্রমাণিত হয়নি।
একটু পরই আপনি একজন ছাত্রকে তার ল্যাবরেটরীতে দেখতে পাবেন। দেখতে পাবেন, সে তার পরামর্শদাতাদের সাথে গোপন পরামর্শ করছে। নিজের এবং অন্যান্য দের উপকার করার কি যে ক্ষমতা এই ছাত্রের, দেখে আশ্চর্য হয়ে যাবেন আপনি।
তার আগে দুটো মানসিক অনুশীলন আছে, দুটোই এক বন্ধুর শরীর পরীক্ষা সংক্রান্ত। এই পরীক্ষার সাথে এর আগে করা পোষা প্রাণী পরীক্ষার তেমন কোনো তফাৎ নেই, এক্ষেত্রে শুধু আরো বেশি খুটিয়ে সব কিছু লক্ষ্য করতে হবে। কাজগুলো শেষ হলে, ছাত্ররা জোড়া বাঁধে।