এখানে আরো একজনের কাহিনী না বললেই নয়। ডেট্রয়ট, মিশিগানের একজন নান, সিসটার বারবারা। সিসটার বারবারার কাহিনী বেছে নেয়ার কারণ, ধ্যানমগ্ন। অবস্থাটাকে অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে ব্যবহার করে মনের কাছ থেকে দুর্লভ একটা চিকিৎসা আদায় করে নিতে পেরেছেন তিনি।
কাছের জিনিস দেখতে পান না বলে সাতাশ বছর ধরে চশমা পরেন সিসটার বারবারা। যতোই কম দেখতে পেতেন, তাঁর চশমার লেন্স ততোই বাড়াতে হতো, এবং এক সময় বোঝা গেল তিনি দূরের জিনিসও আগের মতো ভালো দেখতে পাচ্ছেন না। শেষ পর্যন্ত তাঁকে বাইফোকাল নিতে হলো। তারপর উনিশ শো চুয়াত্তর সালে, তিনি ঠিক করলেন মন-নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির সাহায্য নেবেন। গভীর ধ্যান করে নিজেকে তিনি বললেন, যতো বার আমি চোখের পাতা ফেলবো, সবকিছু নিখুঁতভাবে পরিষ্কার দেখতে পাবো, ঠিক ক্যামেরার মতো। ধ্যানমগ্ন হলে প্রতিবার এই কথাগুলো পুনরাবৃত্তি করতেন তিনি। দু’হপ্তা পর দেখা গেল, তিনি চশমা ব্যবহার করছেন না, তবে পড়াশোনার সময় ওটা লাগে। তিনি ডাক্তার রিচার্ডের সাথে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করলেন। পরীক্ষা করে দেখে ডাক্তার রিচার্ড তাঁকে জানালেন, আপনার কর্ণিয়ার আকৃতিতে সামান্য একটু গোলমাল আছে। ডাক্তারের কাছ থেকে ক্রটিটা কি জানার পর সিসটার বারবারা তাঁর ধ্যানের মধ্যে একটা নতুন সাজেশন জুড়ে দিলেন, আমার কর্ণিয়াতে যে গোলমাল আছে তা যেন সেরে যায়। এভাবে কয়েক হপ্তা কেটে যাবার পর আবার তিনি ডাক্তারের কাছে গেলেন।
ড. রিচার্ড অনেক পরে তাঁর এক রিপোর্টে কি লিখেছেন, দেখুন।
বিশে আগস্ট, উনিশ শশা চুয়াত্তর, সিসটার বারবারাকে প্রথম আমি পরীক্ষা করি ।
পরে আবার তাঁকে আমি পরীক্ষা করি ছাব্বিশে আগস্ট, উনিশ শো পঁচাত্তরে। গত এক বছর ধরে তিনি চশমা ব্যবহার করছিলেন না
আমার রোগিনীর মাইওপিয়া সুস্পষ্টভাবে এমন এক পর্যায়ে নেমে এসেছে। যেখানে চশমা ব্যবহার করার কোনো দরকার করে না।
ডাক্তার সাহেবের মাইগ্রেন মাথাব্যথা বা সিসটারের দৃষ্টি ক্ষীণতা, দুটোর একটাও তেমন ভয়ঙ্কর কোনো রোগ নয়। কিন্তু ভয়ঙ্কর কোনো রোগ যদি আক্রমণ করে, তখনো কি আমরা এই পদ্ধতির সাহায্য পাবো? নাকি শুধু ওষুধ খাবো আর নিজেকে ছেড়ে দেবো ভাগ্যের ওপর? আসুন, সবচেয়ে ভীতিকার রোগ, ক্যানসারের দিকে একটু তাকানো যাক।
ক্যানসার বিশেষজ্ঞ ড, ও কার্ল সিমনটন-এর নাম এবং তাঁর গবেষণা সম্পর্কে অনেকেই শুনেছেন। তাঁর এই গবেষণার কিছুটা বর্ণনা পাওয়া যায় মেরিলিন ফার্গুসনের লেখা জনপ্রিয় বই ‘দি ব্রেন রেভোলিউশন’-এ। উনিশ শো ছিয়াত্তর সালে প্রিভেনশন ম্যাগাজিন তাঁর সম্পর্কে একটা প্রবন্ধ ছাপে, প্রবন্ধটার নাম দেয়া হয়, মাইও ওভার ক্যানসার, লেখক ছিলেন গ্রেস হলসেল। ড. সিমনটন মনকে নিয়ন্ত্রণ করার টেকনিক শিখেছিলেন, তাঁর রোগীদের চিকিৎসা করার জন্যে এই সব টেকনিক সাফল্যের সাথে ব্যবহার করেন।
সানফ্রান্সিসকোর কাছে ট্রাভিজ এয়ারফোর্স বেসে রেডিয়েশন থেরাপির চার্জে থাকার সময় একটা দুর্লভ কিন্তু অতি পরিচিত রহস্যের প্রতি দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় তাঁর।–কেউ কেউ ক্যানসার থেকে সেরে ওঠে, অথচ চিকিৎসা বিজ্ঞান এর কোনো কারণ ব্যাখ্যা করতে পারে না। এই ধরনের রোগমুক্তিকে স্পনটেনিয়াস রেমিশন বলে। কিন্তু হাজারে বা লাখে মাত্র দু’ একজন রোগী এই নিষ্কৃতি পেয়ে থাকে। তিনি যুক্তিশক্তি দিয়ে উপলব্ধি করলেন, কেন এরা ভালো হয়েছে তা যদি জানা যায় তাহলে হয়তো আরো রোগীর ভালো হবার কারণ সৃষ্টি করা সম্ভব হবে।
গবেষণা করতে গিয়ে ড. সিমনটন দেখলেন, যারা ভালো হয়েছে তাদের সবার। মধ্যে অদ্ভুত একটা মিল রয়েছে। এরা সবাই যার যার জীবনে সন্তুষ্ট, আশাবাদী; ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী, আত্মবিশ্বাসী এবং দৃঢ়চেতা। একটা কনভেনশনে বক্তৃতা দেয়ার সময় তিনি যা বলেছিলেন এখানে তার অংশবিশেষের সার উল্লেখ করা হলো।
সাধারণভাবে ক্যানসারের বেড়ে ওঠা সম্পর্কে তদন্ত চালাতে গিয়ে, রোগটা ব্রা। পড়ার ছয় থেকে আঠারো মাস আগে, তাৎপর্যপূর্ণ একটা মানসিক বিপর্যয় চিহ্নিত করতে পেরেছেন তদন্তকারীরা।
স্বাধীন অনুসন্ধানকারীদের বিভিন্ন জোট দীর্ঘ মেয়াদী পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে এই ব্যাপারটা সনাক্ত করেন। আমরা দেখি, শুধু ওই বিপর্যয়টাই তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার। নয়, আসলে ব্যক্তিটি ওই বিপর্যয়টাকে যেভাবে গ্রহণ করছেন সেটাই তাৎপর্যপূর্ণ।
ওই বিপর্যয় বা ক্ষতি পরিমাণে এতো বেশি যে একটা অসহায় বোধ, একটা নৈরাশ্য বোধ রোগীকে সম্পূর্ণভাবে গ্রাস করে ফেলে। এতে করে তার মূল প্রতিরোধক শক্তিটি ধ্বংস হয়ে যায়, এবং এই সুযোগে ভয়ঙ্কর রোগটি বেড়ে উঠে রোগীকে শয্যাশায়ী করে ফেলে।
ট্রাভিজ এয়াফোর্স বেসে আরেকটা পরীক্ষা চালানো হয়। জার্নাল অব ট্রান্স। পারসোনাল সাইকোলজি-তে এই পরীক্ষা সম্পর্কে লেখা হয়েছিল। একশো বাহান্ন জন। ক্যানসার রোগীকে নিয়ে পরীক্ষাটা ড. সিমনটন চালান। এদের মধ্যে প্রচণ্ড আশাবাদী অর্থাৎ হা-সূচক চিন্তা-ভাবনার অধিকারী লোকও যেমন ছিলো, তেমনি প্রচণ্ড হতাশাগ্রস্ত, না-সূচক চিন্তা-ভাবনায় মুষড়ে পড়া লোকজনও ছিলো। থেরাপি চিকিৎসা কার কতোটা ভালো করে, পরীক্ষা করতে গিয়ে ড. সিমনটন দেখেন, বিশজনের বেলায়। চিকিৎসার ফল অত্যন্ত ভালো পাওয়া গেল। যদিও এদের মধ্যে চোদ্দ জনেরই অবস্থা। অত্যন্ত গুরুতর ছিলো, শতকরা পঞ্চাশ ভাগেরও কম সম্ভাবনা পাঁচ বছর বাঁচবে কিনা। তবু চিকিৎসায় কাজ হওয়ার কারণ হলো, এরা কেউ ভেঙে পড়েনি, প্রবণতার দিক থেকে সবাই ছিলো আশাবাদী। অপরদিকে, বাইশ জনের বেলায় চিকিৎসার ফল ভালো হলো না। এরা সবাই হতাশায় মুষড়ে পড়া মানুষ।