না, না, শরীর খারাপ লাগছে না।
তবে?
তোমাকে দেখছি।
সুমিত্রা তাবাক হয়ে প্রশ্ন করে, তার মানে?
প্রবীর সুমিত্রার মুখের সামনে মুখ নিয়ে মুগ্ধ বিস্ময়ে একবার ওকে দেখে। তারপর বলে, হ্যাঁ মিত্রা, তোমাকে দেখতে এত ভাল লাগে যে কিছুতেই ঘুম আসে না।
তাই বলে রাত জেগে আমাকে দেখবে? হ্যাঁ। দেখে দেখে আশা মেটে না?
হ্যাঁ।
কেন?
দিনে আমরা সবাই দায়িত্ব-কর্তব্যের দাস। তাই তখন আমাদের আসল রূপটা দেখা যায় না। রাত্তিরেই মানুষের সৌন্দর্য।
সুমিত্রা হাসতে হাসতে বলে, তাই বলে এত রাত্রে আর আমার মত বুড়ীর সৌন্দর্য দেখতে হবে না। তাছাড়া এভাবে ক রাত্তির আমার সৌন্দর্য দেখলে তোমাকে আর সুস্থ থাকতে হচ্ছে না।
প্রবীর বলে, অসুস্থ হলে তো তোমাকে সব সময় কাছে পাবো।
.
সব শোনার পর সাবিত্রী বললেন, সত্যি ঠাকুরপো একটা আস্ত পাগল।
সুমিত্রা একটু আত্মতৃপ্তির হাসি হেসে বললো, তোমার ঠাকুরপো সত্যিই পাগল! একটু থেমে, একটু এদিক-ওদিক দেখে, একটু চাপা গলায় বললো, সারা রাত ঠিক বাচ্চা ছেলের মত আমার বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে শুয়ে থাকবে। সকালবেলায় ঘুম ভাঙ্গার পর ওকে ঐভাবে শুয়ে থাকতে দেখে ভীষণ মায়া হয়।
সাবিত্রী বলেন, ঠাকুরপো সম্পর্কে তোমার দাদাও ঠিক ঐ কথাই বলেন।
দাদা কি বলেন?
বলেন, প্রবীরের চোখ দুটো দেখলেই ভীষণ মায়া হয়।…
আর কি বলেন?
বলেন, প্রবীরের বয়স হয়েছে, কিন্তু তবু ওকে ছোট ছেলের মত আদর করতে ইচ্ছে করে।
দাদাকে ও দারুণ শ্রদ্ধা করে।
সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
অফিসের কাজের জন্য প্রবীরবাবু বেশী দিন আসতে না পারলে সুমিত্রা একলাই চলে আসে। বিকেলের দিকে অফিসছুটির পর প্রবীরবাবু এখান থেকে সুমিত্রাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যান।
সুমিত্রা এলে সারা দুপুর সাবিত্রীর সঙ্গে গল্প হবেই।
জানো বৌদি, যে মেয়েয়া কোনদিন কাউকে ভালবাসেনি বা কারুর ভালবাসা পায়নি তারা যে কোন পুরুষের কাছে নিজেদের সর্বস্ব বিলিয়ে দিতে পারে। কিন্তু আমার মত মেয়েরা তা পারে না।
সাবিত্রী বলেন, প্রবীরবাবু সত্যি অপূর্ব মানুষ।
আমি তো ভগবানের চাইতেও ওকে বেশী ভালবাসি, শ্রদ্ধা করি।
নিশ্চয়ই করবে।
সুমিত্রা একটু হেসে বলে, আমি ওকে কি বলি জানো?
কি?
বলি, রামচন্দ্র চোদ্দ বছর বনবাসে গিয়েছিলেন বলেই যদি রামায়ণ লেখা যায়, তাহলে তুমি আমার জন্য কুড়ি বছর অপেক্ষা করেছ বলে রামায়ণের চাইতে বড় কিছু লেখা যায়।
সাবিত্রী একটু হেসে জিজ্ঞাসা করেন, প্রবীরবাবু কী বলেন?
সুমিত্রাও হাসে। বলে, ও বলে, সে মহারামায়ণ আমাকেই লিখতে হবে, আমাকেই পড়তে হবে।
এবার সাবিত্রী একটু চাপা হাসি হেসে বলেন, তোমার মত মেয়েকে ভালবেসেছিলেন বলেই উনি কুড়ি বছর অপেক্ষা করেছিলেন।
তার মানে?
এই বয়সেও তোমার রূপ দেখে অনেক পুরুষেরই মাথা ঘুরে যাবে।
সুমিত্রা একটু লজ্জিত বোধ করে। বলে, তা তো বটেই।
সাবিত্রী ওর গাল টিপে বলেন, এমন সর্বনাশা রূপসীর প্রেমে পড়লে কি কোন পুরুষের বাঁচার উপায় থাকে?
.
সুমিত্রা এলে সাবিত্রীর আর কাজে মন লাগে না। কোন মতে কাজকর্ম করেই গল্প করবে। সুমিত্রার সঙ্গে গল্প করতে ওর এতই ভাল লাগে যে রমেনবাবু একটু বেশী বাজার করলেই উনি বলেন, আচ্ছা, তুমি কী ভেবেছ বল তো?
রমেনবাবু অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন, আমি আবার কী করলাম?
আমাকে না বলেই এত মাছ আনলে কেন?
এবার রমেনবাবু হেসে বলেন, রোজ রোজ তো এসব মাছ পাওয়া যায় না। তাছাড় দিদি এসেছে…
ওকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই সাবিত্রী স্বগতোক্তি করেন, কোথায় একটু গল্পগুজব করব। তা না! এখন আমাকে সারাদিন এই রান্নাঘরের মধ্যে বন্দিনী হয়ে থাকতে হবে।
রমেনবাবু তখনও হাসেন। বলেন, তুমি একলা একলা রাঁধবে কেন? দিদিও নিশ্চয়ই কিছু রাঁধবে।
তোমার দিদি যদি রান্নাঘরে থাকে, তাহলে কী আমি চেয়ার টেবিলের সঙ্গে গল্প করব?
দিদি যখন রান্নাঘরে কাজ করবে, তখন তুমি আমার সঙ্গে গল্প করবে।
সুমিত্রা বাথরুম থেকে স্নান করে বেরিয়েই বলে, হ্যাঁ বৌদি, তুমি দাদার সঙ্গে গল্প করো। আমি রান্না করে দেব।
সাবিত্রী হেসে বলে, তোমার দাদার ন্যাকামির কথা বাদ দাও। মাঝে মাঝে তোমার দাদা এমন ঢং দেখায় যে…….
সাবিত্রীর কথা শুনে সুমিত্রা হাসে। রমেনবাবু সুমিত্রার সামনে এইসব কথা শুনে অস্বস্তি বোধ করেন, লজ্জিত হন। তাই বলেন, বলছিলাম, অনেক দিন তত দিদির হাতের রান্না খাই না, তাই…
সুমিত্রা বলে, তুমি যাই বলল বৌদি, আজ আমি তোমাকে রান্নাঘরে ঢুকতে দিচ্ছি না।
সুমিত্রা-প্রবীরবাবুর বিয়ের পর শুধু ওদের জীবনেই নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয় নি; ওদের বিয়ের পর ম্যারেজ রেজিস্ট্রার রমেন সোম ও তাঁর স্ত্রী সাবিত্রীর জীবনেও আনন্দের জোয়ার এসেছে।
.
এখন রমেন সোমের বয়স পঞ্চাশ পার হয়ে গেছে। জীবনে অনেক অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার পরই উনি ম্যারেজ অফিসার হন, কিন্তু এই নতুন ভূমিকায় স্বল্পকালীন সময়ে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন, তা বহু মানুষ সারা জীবনেও সঞ্চয় করতে পারে না।
এক দল ছেলেকে সঙ্গে এনে যেদিন দিলীপ আর মায়া বিয়ের নোটিশ দিতে এসেছিল, সেদিনই ওর একটু খটকা লেগেছিল। তবে আইন অনুসারে যে কোন আঠারো বছরের মেয়ে আর একুশ বছরের ছেলে নিজেদের পছন্দমত বিয়ে করতে পারে বলে উনি কিছু বলেননি। নোটিশ দেবার ঠিক এক মাস পরে যেদিন ওরা বিয়ে করল, সেদিনও মিঃ সোম কোন আগ্রহ দেখান নি। আইনমত কর্তব্য সম্পাদন করে সার্টিফিকেট দিয়েছেন, আমি রমেন্দ্রনাথ সোম এতদ্বারা নিশ্চিতভাবে জানাইতেছি যে……শ্রীদিলীপ ঘোষ ও শ্ৰীমতী মায়া ঘোষ (বসু) আমার সামনে হাজির হন এবং নীচে স্বাক্ষরিত তিনজন সাক্ষী সমক্ষে ১১নং ধারা অনুযায়ী ঘোষণা করিবার পর আইনানুসারে আমার সামনে উহাদের বিবাহ সম্পাদিত হয়।