মিঃ সোম সুবীরের কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, তুমি যে খাঁটি সোনা তা তোমাকে প্রথম দিন দেখেই বুঝেছিলাম। একটু থেমে বললেন, তাহলে তোমার রেজাল্ট বেরুবার পর আনুষ্ঠানিক ভাবেই বিয়ে করো।
হ্যাঁ তাই করব।
সাবিত্রী আর নন্দিতা বাইরের ঘরে আসতেই মিঃ সোম বললেন, বসো। তারপর হাসতে হাসতে নন্দিতার দিকে তাকিয়ে বললেন, বেহালার একটি ছেলের সঙ্গে তোমার বিয়ের সম্বন্ধ করার জন্য দীপেন কলকাতায় এসেছিল।……
নন্দিতা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ছোটমামার আসার খবর আপনি জানলেন কী করে?
সাবিত্রী হাসতে হাসতে বললেন, দীপেন ঠাকুরপো ওর ক্লাশ ফ্রেণ্ড। উনি কলকাতায় এলে সব সময় আমাদের এখানেই থাকেন।
নন্দিতা প্রায় চিৎকার করে উঠল, তাই নাকি?
মিঃ সোম জিজ্ঞাসা করলেন, দীপেন কী কী কাজে কলকাতা এসেছিল জানো?
নন্দিতা মাথা নেড়ে বললো, না।
তোমার বিয়ের জন্য তোমাদের হালিশহরের বাড়ী বিক্রি করতে আর বেহালার ছেলের সঙ্গে তোমার বিয়ে পাকা করতে।
এতক্ষণ শোনার পর সুবীর জিজ্ঞাসা করল, উনি যে নন্দিতার মামা তা জানলেন কেমন করে?
দীপেনের কাছে নন্দিতার ফটো দেখেই……….
নন্দিতা বললো, ছবিটা না দেখলেই কেলেঙ্কারি হতো।
সাবিত্রী হাসতে হাসতে বললেন, দীপেন ঠাকুরপোকে উনি কথা দিয়েছেন তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করবেন।
সুবীর একটু হেসে নন্দিতাকে বললো, ভগবান আমাদের ঠিক জায়গাতেই পৌঁছে দিয়েছেন।
.
প্রবীরবাবু আর সুমিত্রা ভি. আই. পি. রোডে থাকলেও মাঝে মাঝে আসেন। না এসে পারেন না।
সুমিত্রার হাতে মিষ্টির প্যাকেট দেখেই মিঃ সোম বলেন, দিদি, রোজ রোজ মিষ্টি নিয়ে আসা কী ঠিক হচ্ছে?
সুমিত্রা একটু কপট গাম্ভীর্য এনে বলেন, একশ-বার ঠিক হচ্ছে। মিষ্টি আনি বলে কি আপনি আমাকে তাড়িয়ে দিতে পারবেন?
না দিদি, সে সাহস নেই।
সাবিত্রী বলেন, জানো সুমিত্রা, তোমার দাদা এখন সব নেমন্তন্ন বাড়ীতেই তোমার ভাইফেঁটায় দেওয়া ধুতি-পাঞ্জাবি পরে যাবেন আর সবাইকে বলবেন……….
সুমিত্রা কপালে হাত দিয়ে বলেন, হা ভগবান! ঐ ধুতি-পাঞ্জাবির কথা আবার সবাইকে বলেন?
মিঃ সোম বলেন, তুমি যেমন একশবার মিষ্টি আনবে, আমিও সেইরকম ধুতি-পাঞ্জাবির কথা একশবার সবাইকে বলব।
সুমিত্রা বললো, ঠিক আছে। সামনের বার আন্ডারওয়ার-গেঞ্জি দেব। দেখি, কি করে বলে বেড়ান।
তুমি দিতে পারলে আমিও বলতে পারব।
দেখতে দেখতে মিঃ সোমের এখানে কয়েক শ ছেলেমেয়ের বিয়ে হলো; কিন্তু এ ধরনের মধুর সম্পর্ক দু-চারজনের সঙ্গেই গড়ে উঠেছে।
বিয়ের পর সুমিত্রা চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। সাবিত্রীকে বলে, যখন নিঃসঙ্গ ছিলাম তখন বাধ্য হয়ে চাকরি করেছি। কিন্তু এখন আর টাকার লোভে চাকরি করতে ইচ্ছে করে না।
সাবিত্রী সঙ্গে সঙ্গে তাকে সমর্থন জানান, ঠিক করেছ।
সুমিত্রা বলে, এর আগে আমার বিয়ে হয়েছিল ঠিকই কিন্তু সংসার করি নি।
সাবিত্রী ওর কথার অর্থ ঠিক বুঝতে পারেন না। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সুমিত্রার দিকে তাকাতেই ও বলে, যে মহাপুরুষের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছিল, সে একদিনের জন্যও আমাকে স্ত্রীর মর্যাদা দেয় নি। তাছাড়া এত বেশী নেশা করতো যে, যখন ঘরে আসতো তখন তার কোন জ্ঞানই থাকত না।
সাবিত্রী বললেন, মাঝখান থেকে শুধু শুধু তোমার জীবনটা ওলট-পালট হয়ে গেল।
তাছাড়া বাবার সারা জীবনের সঞ্চয় নষ্ট হলো। সুমিত্রা এবার একটু হেসে বললো, যাই বলল বৌদি। এখন আর আমার কোন দুঃখ নেই। প্রবীরকে পেয়ে আমার জীবন ধন্য হয়েছে।
সত্যি ঠাকুরপোর মত ছেলে হয় না।
আমি জানতাম, প্রবীর ভাল কিন্তু সতের বছর পর ওকে আবার নতুন করে পেয়ে বুঝলাম, ও অসাধারণ।
তা না হলে কেউ সতের বছর ধরে এইভাবে জীবন কাটাতে পারে?
সুমিত্রা একটু আনমনা হয়। উদাস দৃষ্টি দূরের, বহুদূরের আকাশের কোলে ঘোরাঘুরি করে। সাবিত্রী ওর দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারে, সুমিত্রা কাছে বসেও দূরে চলে গেছে। ফেলে আসা দিনের স্মৃতি রোমন্থন করছে। কখনও খুশির হাসিতে মুখখানা উজ্জ্বল ভাস্বর হয়ে উঠছে; কখনও আবার ব্যথা-বেদনায় ম্লান হচ্ছে ঐ উজ্জ্বল সুন্দর মুখখানা।
বেশ কিছুক্ষণ পরে সাবিত্রী জিজ্ঞাসা করল, কী ভাবছ?
ভাবছি তোমার ঠাকুরপোর কথা। তুমি শুনলে অবাক হয়ে যাবে যে বিয়ের পর তোমার ঠাকুরপোর ঘর করতে গিয়ে কী দেখলাম জানো?
কী?
দেখলাম, আলমারির মধ্যে সতেরটা শাড়ী রয়েছে।…
আচ্ছা।
ঐ শাড়ীগুলো কিসের জানো? কিসের?
আগে ও আমার জন্মদিনে প্রতি বছর একটা শাড়ী দিতো। যে সতের বছর আমাকে কাছে পায় নি, সেই সতের বছরেও আমার জন্মদিনে ও প্রতি বছর শাড়ী কিনেছে।
কী আশ্চর্য!
সুমিত্রা একটু হেসে বললো, আগে আগে আমরা দুজনে খুব থিয়েটার দেখতাম। তোমার ঠাকুরপো আমাকে কাছে পায় নি বলে একলা একলা একটাও থিয়েটার দেখে নি।
তাই নাকি?
হ্যাঁ বৌদি। এই লোকটা আমার জন্য যে কী আত্মত্যাগ করেছে তা ভাবলেও অবাক লাগে।
এই আত্মত্যাগ করেছে বলেই তো ঠাকুরপো তোমাকে হারিয়েও আবার পেয়েছে।
আবার একটু চুপচাপ। আবার সুমিত্রা কোথায় যেন হারিয়ে যায়।…
জানো বৌদি, মাঝে মাঝে হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখি, তোমার ঠাকুরপো বসে আছে।
.
কী হলো? বসে আছো কেন?
প্রবীর একটু হেসে বললো, ঘুম আসছে না।
কেন? শরীর খারাপ লাগছে?