হ্যাঁ, হ্যাঁ।…
ইন্দিরা আলতো করে ছেলেটির কাঁধে হাত দিয়ে বললো, সুবীর মুখার্জী। মেয়েটিকে দেখিয়ে বললো, নন্দিতা ব্যানার্জী। পঞ্জিকাতে কোন আইন লঙ্ঘন না করেই এদের বিয়ে ঠিক করা হয়েছে।
ইন্দিরার কথায় সবাই হাসেন।
আরো একটু কথাবার্তার পর সুবীর আর নন্দিতা ফর্ম ভর্তি করে, ফর্মের নীচে সই করে।
মিঃ সোম বললেন, বিয়ের দিন তোমরা সবাই আমার এখানে মিষ্টি খেয়ে যাবে।
মাসখানেক পরে এই ছেলেমেয়েরা আবার এসে হাজির। সুবীর আর নন্দিতা বর-বৌ-এর মতো সেজেছে। দুজনের কপালেই চন্দনের ফোঁটা। ইন্দিরার হাতে দুটি মালা।
মিঃ সোম ১৯৫৪ সালের স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্টের থার্ড সিডিউলের ২১নং ধারা অনুযায়ী পাত্রপাত্রীর ডিক্লারেশন ফর্ম বের করলেন।
আই, শ্ৰীসুবীর মুখার্জী, হিয়ারবাই ডিক্লেয়ার অ্যাজ ফলোজ—
(১) আমি বর্তমানে অবিবাহিত,
(২) আমার বাইশ বছর বয়স হয়েছে,
(৩) কুমারী নন্দিতা ব্যানার্জীর সঙ্গে আমার নিষিদ্ধ সম্পর্কের আত্মীয়তা নেই,
(৪) আমি জানি এই ঘোষণায় মিথ্যা তথ্য থাকলে এবং…আমার জেল ও জরিমানা হতে পারে।
এর নীচে সুবীর মুখার্জী সই করল। অনুরূপ ঘোষণা করার পর নন্দিতাও সই করল। তারপর তিনজন সাক্ষী ও মিঃ সোম সই করলেন। তারপর ওঁর নির্দেশমতো সুবীর বললো, আই শ্ৰীসুবীর মুখার্জী টেক দি নন্দিতা ব্যানার্জী অ্যাজ মাই লফুল ওয়াইফ। নন্দিতা বললো, আমি নন্দিতা ব্যানার্জী,সুবীর মুখার্জীকে আইনসঙ্গত স্বামী হিসেবে গ্রহণ করলাম।
তারপর মালাবদল হলো ও সুবীর নন্দিতার সিথিতে সিঁদুর দিল। হঠাৎ একজন শাঁখ বাজিয়ে সমস্ত পরিবেশটাকে আরো আনন্দময় করে তুললো।
সাবিত্রী এসব বিয়ের সময় বাইরের ঘরে আসেন না, তবে ওদের সবার অনুরোধে আজ শুধু উপস্থিতই ছিলেন না, বরণডালা দিয়ে বরণ করে আশীর্বাদও করলেন। সুবীর আর নন্দিতা মিঃ সোম আর সাবিত্রীকে প্রণাম করল।
এর ঠিক দিনতিনেক পরের কথা। মিঃ সোমের ছাত্রজীবনের বন্ধু দীপেন চ্যাটার্জী এসে হাজির।
মিঃ সোম খুশির হাসি হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, কী ব্যাপার তোমার? তিন-চারখানা চিঠি দিয়েও…
দীপেনবাবু বললেন, তোমার সব চিঠিই পেয়েছি। কিন্তু জবাব দেবার মতো অবস্থা ছিল না।
কেন? কী হলো?
তোমার কপালে চিরযৌবনা স্ত্রী জুটলেও আমার কপালে…
মিঃ সোম হাসতে হাসতে বললেন, পরে আমার স্ত্রীর প্রশংসা করো। আগে বল বৌদির কী হয়েছিল?
আরে ভাই বলো না, হঠাৎ ওর চোখের দৃষ্টি কমতে শুরু করল।
তারপর?
তারপর হঠাৎ চোখ দিয়ে রক্ত পড়তে শুরু করল।
বল কী?
হ্যাঁ ভাই। সে যে কী ঝামেলার মধ্যে কটা মাস কাটিয়েছি—
এখন কেমন আছেন?
শেষ পর্যন্ত পিনাকী রায়কে দেখিয়ে চশমা নেবার পর থেকে ভালই আছে।
আমার এক মাসতুতো ভাই তো প্রায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাকেও পিনাকী রায় ভাল করে দিয়েছেন।
নর্থ বেঙ্গলে তো দূরের কথা, সারা বাংলাদেশে অমন চোখের ডাক্তার আছেন কিনা সন্দেহ।
সাবিত্রী বাথরুম থেকে বেবিযে এসে দীপেনবাবুকে দেখেই হাসতে হাসতে বললেন, এত দিন পবে আমাদের মনে পড়ল।
দীপেনবাবু তার স্ত্রীর অসুস্থতার কথা বলার পর বললেন, ছ-মাসের চেষ্টায় আজ কলকাতা এলাম।
এই এক বছবেব মধ্যে আব কলকাতা আসেননি?
না বৌদি। কলকাতায় এসে তো আপনাদের এখানে ছাড়া আর কোথাও উঠি না।
রাত্রে খাওয়াদাওয়ার পর দুই বন্ধুতে বাইরের ঘরে বসে গল্প করছিলেন।
মিঃ সোম জিজ্ঞাসা কবলেন, তুমি কি মামলামোকদ্দমার কাজে এসেছ?
না ভাই, এবার কোন মামলামোকদ্দমার কাজে আসি নি। এবার আমার এক ভগ্নীপতির কাজে এসেছি।
কী কাজ?
হালিশহরে আমার ভগ্নীপতির কিছু সম্পত্তি আছে। সেটা বিক্রির ব্যাপারে কয়েকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে এসেছি।
হঠাৎ হালিশহরের সম্পত্তি বিক্রি করছেন কেন?
আমার এই ভগ্নীপতি এককালে খুবই বড়লোক ছিল কিন্তু এখন বড়ই বিপদের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। হালিশহরের সম্পত্তি বিক্রি না করে ওর পক্ষে মেযের বিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়, অথচ–
অথচ কী?
এই হালিশহরের বাড়িভাড়া থেকে ওর তিন মেয়ের পড়াশুনার খরচা চলছে।
তাহলে কেন বিক্রি করছেন?
ওদের এমনই ফ্যামিলির ধারা যে মেয়ের বিয়ে দিতে অন্ততপক্ষে হাজার চল্লিশেক টাকা দরকার।
চল্লিশ হাজার?
হ্যাঁ ভাই। এর কমে ঐ ফ্যামিলির মেয়ের বিয়ে হয় না।
হালিশহরের বাড়ি বিক্রি করে কত টাকা হবে?
বড় জোর পঞ্চাশ। দীপেনবাবু একটু থেমে বললেন, আমার দিদির তিনটি মেয়েই লেখাপড়ায় অত্যন্ত ভাল। বড় মেয়েটি কলকাতায় এম. এ. পড়ছে, আর দুটি মেয়ে গৌহাটিতে পড়ছে। হালিশহরের বাড়ি বিক্রি হবার পর হয়ত ছোট মেয়ে দুটোর পড়াশুনোই বন্ধ হয়ে যাবে।
মিঃ সোম একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলেন, মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে কত পরিবার যে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, তার ঠিকঠিকানা নেই।
হালিশহরের বাড়ি বিক্রি করে আমার এই বড় ভাগ্নীর বিয়ে হলে এই ফ্যামিলিটাও ধ্বংস হয়ে যাবে।
তবু ফ্যামিলি ট্রাডিশন রাখতে হবে?
হ্যাঁ ভাই। তা না রেখে বুঝি ওদের উপায় নেই।
একটু পরে মিঃ সোম জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার বড় ভাগ্নীর বিয়ে কি ঠিক হয়ে গেছে?
না, ঠিক হয়নি, তবে সে ব্যাপারেও আমাকে একটা ছেলে দেখতে হবে।
ছেলে কি কলকাতায় থাকে?
হ্যাঁ, বেহালায় ওদের নিজেদের বাড়ি আছে।–
ছেলেটি কি করে?