সুব্রত আর অঞ্জলি ফর্ম নিয়ে ওপাশের টেবিলে চলে যেতেই মিঃ সোম জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা কি চা খাবেন?
ওঁরা দু-তিনজন একসঙ্গে বললেন, না, না, চায়ের দরকার নেই।
ওঁরা আর বেশীক্ষণ অপেক্ষা করেন না। অঞ্জলি আর সুব্রত ফর্ম ভরে দেবার পরই ওঁরা চলে যান।
.
ওঁরা চলে যাবার পরও রমেন সোম চেয়ার ছেড়ে উঠতে পারেন। কত কী ভাবেন না, কত কী মনে পড়ে।
উনি মনে মনে আশা করেছিলেন, যারা স্বামী-স্ত্রী হিসেবে সমাজের মুখোমুখি দাঁড়াতে সাহস করবে না, শুধু তারাই ওর কাছে বিয়ের জন্য আসবে কিন্তু এরা কজন এসে ওর চোখ খুলে দিলেন।
সত্যি হিন্দু সমাজে প্রত্যেকটি আনন্দোৎসব যেন এক একটা অভিশাপ। একটা শিশু জন্ম হবার পর থেকেই শুরু হয় উৎসব। ষষ্ঠী পূজা থেকে শুরু করে মরার পর শ্রাদ্ধ করেও তার শেষ নেই। প্রথম বছর মাসে মাসে শ্রাদ্ধ করতে হবে, তারপর বছর বছর। শাস্ত্র বলে, অবস্থা অনুযায়ী ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করতে হবে। তাই তো সীতা গয়ায় বালির পিণ্ড দিয়ে পিতৃপুরুষের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পেরেছিলেন কিন্তু আজকের দিনে দীন দরিদ্রতম ব্যক্তিকেও সর্বস্ব খুইয়ে কিছু অনুষ্ঠান না করলে সে তার নিজের সমাজে টিকতে পারবে না।
মিঃ সোমের হঠাৎ মনে পড়ে অমর মামার কথা। নিজের ভিটে মাটি ছেড়ে নিঃসম্বল অবস্থায় সপরিবারে এসে ঠাঁই নিয়েছেন রানাঘাটে। তারপর কঁচড়াপাড়া। স্কুলে মাস্টারি না পেয়ে শেষ পর্যন্ত স্টেশনের ধারে একটা ছোট্ট চায়ের দোকান খুললেন। ঐ চায়ের দোকানের কেটলি, ডেকচি, কাপ-ডিশ, ইত্যাদি টুকটাক সরঞ্জাম কেনার জন্যও মামীর হাতের একটা চুড়ি বিক্রি করতে হয়।
ঐ চায়ের দোকান থেকে সারাদিনে যে দু-তিন টাকা আয় হতে তাই দিয়ে অমর মামার সংসারের ছটি প্রাণী কোনমতে অনাহারের হাত থেকে বাচছিলেন। বছরখানেকের মধ্যে আশেপাশে অনেক গুলো দোকান আর দু-তিনটে কাঠের গোলা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অমর মামার চায়ের দোকান বেশ জমে উঠল। ঐ ছোট্ট চায়ের দোকান আস্তে আস্তে কাঁচড়াপাড়ার বিখ্যাত অমর কেবিন হলো। তারপর পারিবারিক মর্যাদা সামাজিক কর্তব্য অনুযায়ী দুটি মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে অমর মামার হাত থেকে অমর কেবিন চলে গেল।
অমর মামার কথা মনে হতেই রমেন সোমের মন বিষয় হয়ে ওঠে। মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগে-মানুষ বড় নাকি সামাজিক নিয়ম বড়?
আপন মনেই মিঃ সোম হাসেন। নিজেই নিজের প্রশ্নের জবাব দেন, মানুষ মরুক কিন্তু সামাজিক নিয়ম ঠিক থাক।
হঠাৎ মনে হয়, অমর মামা যদি সর্বস্ব হারিয়ে মেয়ের বিয়ে না দিয়ে স্পেশাল ম্যাবেজ অ্যাক্টের…
না, না, এ সাহস সবার হয় না; হতে পারে না! বাবা, ঠাকুর্দা, চোদ্দপুরুষের ধারা লঙ্ঘন কবে এভাবে মেয়ের বিয়ে দেবার সাহস অমর মামার মতো মানুষের হতে পারে না কিন্তু ডাক্তার, এঞ্জিনিয়ার, কলেজ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক, শিল্পী-সাহিত্যিক, জননেতা? তারাও কি অমর মামার মতো ভীতু? মেরুদণ্ডহীন? নাকি এরা সবাই টাটা বিড়লার মতো কোটিপতি?
অনেক ভাবনা-চিন্তা করেও মিঃ সোম এ প্রশ্নের জবাব খুঁজে পান না। শুধু ভাবেন, তিরিশ-চল্লিশ টাকা ব্যয় করে যদি সব ছেলেমেয়ের বিয়ে হতো, তাহলে বোধহয় ভারতবর্ষের মানুষ গরীব থাকত না।
২. কলকাতা শহরে সাইনবোর্ড
মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য কলকাতা শহরে কত লক্ষ লক্ষ সাইনবোর্ড আছে, তার ঠিক-ঠিকানা নেই।
মিঃ সোম তার ছোট্ট সাইনবোর্ড ঝোলাবার সময় স্বপ্নেও ভাবেননি, এটি এত মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে।
সবার হাতে বইখাতা না থাকলেও ওদের দেখেই মিঃ সোম বুঝলেন ওরা সবাই ছাত্রছাত্রী। ছাত্রছাত্রীর মধ্যে প্রেম-ভালবাসার পর বিয়ে হলে তাদের বন্ধুরা একটু বেশী উৎসাহী হবেই। বিয়ের নোটিশ দেবার সময় শুধু ছেলেটি ও মেয়েটির উপস্থিতি দরকার হলেও একালে বন্ধুবান্ধব আসা অস্বাভাবিক নয়।
মিঃ সোম হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা কি সবাই বিয়ে করবেন?
ওঁর কথায় ছেলেমেয়েরা হেসে উঠল। দু-একটি ছেলেমেয়ের দিকে ইশারা করে জানতে চায়, আমাদের কাউকে পছন্দ হয়? মেয়েরা হাসতে হাসতে মাথা নেড়ে বলে, না।
দুটি ছেলেমেয়ে মিঃ সোমের টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল। ছেলেটি বললো, আমরা বিয়ের নোটিশ দিতে এসেছি।
মুহূর্তের জন্য ওদের দিকে তাকিয়েই মিঃ সোম মুগ্ধ হয়ে গেলেন। বললেন, আপনার বসুন।
ওরা দুজনে প্রায় একসঙ্গে বললে, আমাদের আপনি বলবেন না। আমরা আপনার চাইতে অনেক ছোট।
মিঃ সোম একটু খুশির হাসি হেসে বললেন, আজকাল আর ছাত্র ছাত্রীদের তুমি বলা নিরাপদ নয়।
ছেলেটি চেয়ারে বসে বললে, আপনি বোধহয় ঠিকই বলছেন, তবে আমাদের তুমি বললেই…
মেয়েটি বললো, আমরা তো আপনার প্রায় ছেলেমেয়ের বয়সী হবে।
মিঃ সোম কিছু বলার আগেই একটি ছেলে বললো, এটা কিন্তু লাভ ম্যারেজ নয়; এ বিয়ে আমরা ঠিক করেছি।
মিঃ সোম অবাক হয়ে বললেন, তাই নাকি?
এবার সামনের ছেলেটি বললো, আমাদের বন্ধুরাই এ বিয়ের ঘটকালি করেছে।
মিঃ সোম খুশিতে ঝলমল করে ওঠেন। বলেন, ভেরী গুড।
একটি মেয়ে আরেকটি মেয়েকে সামনে টেনে এনে বললো, এই ইন্দিরাই এ বিয়ের ঘটকালি করেছে।
ইন্দিরা হাতজোড় করে নমস্কার করল। বললো, আপনার সঙ্গে পাত্রপাত্রীর পরিচয় করিয়ে দিই।…