সুমিত্রা বেশ উত্তেজিত হয়েই বললো, জানো কাল সুবীর কী কাণ্ড করেছে?
–কী?
–আমি মার জন্য একটু ফল কিনতে লেকমার্কেট গিয়েছিলাম। হঠাৎ কানে এলো, একটা ছেলে বৌদি বৌদি করে চিৎকার করছে।…
–তারপর?
সুমিত্রা হাসতে হাসতে বলে, আমি তো কল্পনাও করতে পারিনি, কেউ আমাকে বৌদি বলে ডাকতে পারে। তাই ওদিকে নজরও দিইনি।
প্রবীরও হাসছে। হাসতে হাসতে সুমিত্রার দিকে তাকিয়ে আছে।
সুমিত্রা বলে, তারপর হঠাৎ দেখি সুবীর একদল বন্ধুকে নিয়ে আমাকে প্রায় ঘিরে ফেলে বলছে–
তুমি তো আচ্ছা লোক!
কেন? কী করলাম?
এতবার ডাকলাম; তর জবাব দিলে না?
কই আমি তো শুনতে পাই নি।
ষাঁড়ের মতো চিৎকার করে ডাকছি বৌদি বৌদি আর তুমি শুনতে পাওনি?
সুবীর, তুই একটা থাপ্পড় খাবি।
কেন?
বাজারের মধ্যে বৌদি বৌদি করবি কেন?
তবে কি তোমাকে মাসীমা বা দিদিমা বলে ডাকব?
এতক্ষণ শোনার পর প্রবীর হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করল, তারপর কী হলো?
–ওরা সবাই ধরল, বৌদি, আইসক্রীম খাব।…
–খাওয়ালে?
–না খাওয়ালে ওরা আমাকে বাড়ি ফিরতে দিত?
বর্ধমান লোক্যাল ছাড়ার সময় আরো এগিয়ে এসেছে কিন্তু প্রবীরবাবুর সেদিকে খেয়াল নেই। উদাস দৃষ্টিতে প্ল্যাটফর্মের দিকে তাকিয়ে থাকেন আর মনে মনে সেইসব সোনালী দিনের কথা মনে করেন। বেশ খানিকটা দূরে, প্ল্যাটফর্মের ওদিকে, হঠাৎ একটা নারী মূর্তি দেখে উনি চমকে ওঠেন।
কে?
সুমিত্রা?
না, না, সুমিত্রা এখানে কেমন করে আসবে? কেন আসবে?
অসম্ভব।
কয়েকটা মুহূর্তের মধ্যেই সব তর্ক-বিতর্কের অবসান হলো।…
সুমিত্রা!
কে? প্রবীর?
তুমি এখানে?
সুমিত্রা একটু ম্লান হাসি হেসে বললো, ওসব কথা পরে হবে। আগে বলল, কেমন আছো?
প্রবীরও একটু হাসে। বলে, খুব ভাল।
স্ত্রী? ছেলেমেয়ে? সবার কী খবর?
সবাই ভাল আছে।
তুমি কি বর্ধমানে থাকো?
না।
তবে কোথায়?
কলকাতায়।
কলকাতায় কোথায়? ভাবানীপুরের বাড়িতেই?
টালিগঞ্জে।
চেহারা এরকম বিক্রী হয়েছে কেন?
স্ত্রী যত্ন করে না।
কেন?
কেন আবার? সতের বছর সে আমার দেখাশুনা করে না।
প্রবীর!
সুমিত্রা মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
দু-এক মিনিট কেউই কোন কথা বলে না। তারপর প্রবীর প্রশ্ন করে, তোমার কী খবর? তোমার স্বামী কি এখানেই থাকেন?
সুমিত্রা মুখ নীচু করেই খুব আস্তে আস্তে বললো, আমি একটা স্কুলে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে এসেছিলাম। আর আমার স্বামী বিয়ের তিন বছর পরই মারা গিয়েছেন।
সে কী!
অবাক হচ্ছে কেন? অত মদ গিললে কী কোন মানুষ বাঁচতে পারে?
তোমার ছেলেমেয়ে…
প্রবীর, আমার কোন ছেলেমেয়ে নেই। হঠাৎ লোকজনের কলকোলাহল শুনেই বোঝা গেল, ট্রেন ছাড়ার দেরী নেই। প্রবীর ওকে জিজ্ঞাসা করল, তুমিও কি কলকাতা যাবে?
হ্যাঁ।
তাহলে চলল ট্রেনে উঠি। ট্রেন ছাড়ার বোধহয় আর দেরী নেই।
চলো।
.
এতক্ষণ চুপ করে শোনার পর মিঃ সোম প্রশ্ন করলেন, এতদিন আপনারা কেউ কারুর কোন খবরও রাখতেন না?
না।
এতকাল বিয়ে করেননি কেন?
প্রবীর একটু হেসে বললেন, করতে পারিনি। একটু থেমে বললেন, তাছাড়া সব সময়ই মনে হতো, সুমিত্রা একদিন নিশ্চয়ই আমার কাছে আসবে।
যাই হোক ম্যারেজ অফিসার হিসেবে আপনাদের পেয়ে আমি খুব খুশী। ভগবান এবার নিশ্চয়ই আপনাদের সুখী করবেন।
প্রবীর পার্স থেকে নোটিশ দেবার ফি পাঁচ টাকার একটা নোট বের করে বললেন, মাস খানেক পরে আবার আসব।
নিশ্চয়ই আসবেন।
.
দিন তিনেক পরের কথা। বিকেলবেলার দিকে একদল ছেলে আর একটা মেয়ে এসে হাজির। মেয়েটির বয়স নিঃসন্দেহে আঠাবোর অনেক বেশী। তাই ব্যাপারটা একটু গোলমেলে মনে হলেও মিঃ সোম কিছু বললেন না। বিয়ের নোটিশ দেবার ফর্ম বের করার আগেই উনি জিজ্ঞাসা করলেন, উড বী ব্রাইডগ্রম কে?
পিছন থেকে পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের একটা ছেলে সামনে এগিয়ে এসে বললো, আমি।
আপনার নাম?
দিলীপ ঘোষ।
এবার মেয়েটিকে দেখিয়ে মিঃ সোম জিজ্ঞাসা করলেন, এই মেয়েটিকে আপনি বিয়ে করতে চান?
হ্যাঁ।
ওঁর নাম কী?
মায়া বসু।
ইনি আপনার আত্মীয়া কী?
না, না।
কোন কোন আত্মীয়ার সঙ্গে বিয়ে হয় না জানেন?
না, ঠিক জানি না।
মিঃ সোম সঙ্গে সঙ্গে ১৯৫৪ সালের স্পেশ্যাল ম্যারেজ অ্যাক্টের চটি বইখানা বের করেই বললেন, ছেলেরা কাকে কাকে বিয়ে করতে পারে না শুনে নিন।
দু-তিনটি ছেলে একসঙ্গে বললো, বলুন, বলুন।
মিঃ সোম বললেন, সাঁইত্রিশজন আত্মীয়াকে ছেলেরা বিয়ে করতে পারে না। তারা হচ্ছেন–মা, বাবার বিধবা স্ত্রী অর্থাৎ বিমাতা, মার মা, মার বাবার বিধবা অর্থাৎ স্টেপ গ্রাণ্ড মাদার, মার মার মা, মার মার বাবার বিধবা অর্থাৎ…
হঠাৎ কটি ছেলে হেসে উঠল। ঐ ভীড়ের মধ্যে থেকে একজন ছেলে বললো, দাদু, মায়াকে দেখে কি দিলীপের দিদিমা ঠাকুমা মনে হচ্ছে?
ছেলেটির কথায় ওরা সবাই হেসে উঠল।
মিঃ সোম একটু শুকনো হাসি হেসে বললেন, মনে না হলেও আইনের ব্যাখ্যা করা আমার কর্তব্য।
দিলীপ বললো, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন আমাদের মধ্যে কোন আত্মীয়তা নেই। মায়ারা আমাদের বাড়িতে ভাড়া থাকে।
ভাড়াটে বা বাড়ির মালিক, তাতে আমার কিছু আসে-যায় না। এবার মিঃ সোম একটু হেসে বললেন, যে কোন একুশ বছরের ছেলে আঠারো বছরের যে কোন মেয়েকেই বিয়ে করতে পারে, তবে বিয়ে হবে না যদি ছেলেটির স্ত্রী জীবিত থাকে যদি সে উন্মাদ বা জড়বুদ্ধি সম্পন্ন হয়, যদি…