না। আপনাদেরই প্রথম দিলাম।
মিঃ ম্যাথুজ মিঃ সোমকে জড়িয়ে ধরে বললেন, উই আর সো লাকী, উই আর সো হাপি……
মিঃ সোম হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করলেন, এবার কী প্ল্যান।
মিঃ ম্যাথুজ একটু আনমনা হয়ে বললেন, আমি সারা জীবন চাকরি করেছি, বিয়ার খেয়েছি আর তাস খেলেছি। আর এই মেয়েটা ত জীবনে একদিনও প্রাণভরে হাসতে পারে নি। তাই ঠিক করেছি, এবার আমরা একটু আনন্দ করব। এবার উনি একটু হেসে বললেন, দার্জিলিং-কালিম্পং-কার্শিয়াং-এ একমাস ধরে হনিমুন করব।
নিশ্চয়ই আনন্দ করবেন।
এবার মিঃ ম্যাথুজ দু হাত উঁচু করে বললেন, জেন্টলমেন, নাউ উই ডিসক্লোজ আওয়ার ফাইন্যাল প্ল্যান। আমরা দুজনে আপনাদের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি এই হনিমুনের সময়ই কান্তাম্মা উহল বী প্রেগন্যান্ট।
আরো কত ছেলেমেয়ে, মেয়ে-পুরুষ এলেন, গেলেন কিন্তু মিঃ ম্যাথুজ আর কান্তাম্মা মিঃ সোমের মনে যে আবেশ সৃষ্টি করেছিলেন, তা মুছে গেল না।
পচা ভাদ্দর প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। আকাশ-বাতাস মাঝে মাঝেই জানিয়ে দিচ্ছে, শরৎ এসে গেছে।
শেষ রাত্রির থেকেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে। কিন্তু ভোর থেকেই মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। বাড়ীতে মিঃ সোম একা। সাবিত্রী কদিন আগে ওর মাসতুতো বোনের বিয়েতে গেছেন, এখনও ফেরেন নি।
হঠাৎ এই বৃষ্টির মধ্যে কলিং বেল বাজাতেই মিঃ সোম যেন চমকে উঠলেন। আস্তে আস্তে উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখলেন, দুটি ছেলেমেয়ে। উনি অবাক হয়ে বললেন, এই বৃষ্টির মধ্যে এসেছেন?
ছেলেমেয়ে দুটি কোন জবাব না দিয়ে ওর পিছন পিছন ঘরে এসেই মিঃ সোমের পায় হাত দিয়ে প্রণাম করল।
মিঃ সোম একটু অবাক হয়ে বললেন, প্রণাম করছেন কেন?
ছেলেটি ওর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললো, কলকাতায় এসেছি শুধু আপনাকে প্রণাম করতে।
এবার মেয়েটি বললো, সেদিন আপনি সাহায্য না করলে তোত আমাদের আত্মহত্যা করতে হত।
মিঃ সোম ওদের দুজনকে একবার ভাল করে দেখেও ঠিক চিনতে পারলেন না। বললেন, আমি আপনাদের কথা ঠিক বুঝতে পারছি না।
ওরা দুজনে প্রায় এক সঙ্গে বললো, আমাদের আপনি বলছেন কেন?
আচ্ছা, আচ্ছা, তোমাদের নাম কি?
ছেলেটি বললো, আমার নাম প্রবাল—
মিঃ সোম চমকে উঠে বললেন, তুমি প্রবাল?
হ্যাঁ।
বছর চার-পাঁচ আগে এই রকমই বর্ষার মধ্যে–
হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন।
এবার মেয়েটি একটু হেসে বললো, আমি বাণী।
মিঃ সোম এবার একটু হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, আমার দাদুভাই ভাল আছে?
প্রবাল বললো, হ্যাঁ। সে এখন স্কুলে পড়ছে।
এত বড় হয়ে গেল?
বাণী বললো, এত বৃষ্টি হচ্ছে বলে ওকে আনতে পারলাম না। কাল-পরশু ওকে দেখিয়ে নিয়ে যাব।
এতক্ষণ পরে মিঃ সোমের খেয়াল হলো, ওরা সবাই দাঁড়িয়ে। বললেন, বো, বসো।
সবাই বসলেন।
বসার পরই প্রবাল বললো, আপনার একটা কথা আমরা কিছুতেই ভুলতে পারি না।
মিঃ সোম একটু বিস্ময়ের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলেন, কোন কথা?
বাণী বললো, আপনি আমাদের বলেছিলেন, আমি চাই না কোন শিশু কলংকের বোঝা মাথায় নিয়ে এই পৃথিবীতে আসুক।
মিঃ সোম একটু হেসে বললেন, বলেছিলাম নাকি?
প্রবাল বললো, হ্যাঁ।
মিঃ সোম আপন মনে ভাবতে ভাবতে কোথায় যেন তলিয়ে যান। আস্তে আস্তে সেই হারিয়ে যাওয়া পুরানো স্মৃতি ওর মনে পড়ে।
.
সেদিনও ঠিক এই রকমই বৃষ্টি হচ্ছিল। প্রবাল আর বাণী পাগলের মত কাঁদতে কাঁদতে ওর পা জড়িলে ধরল।
আপনি আমাদের বাঁচান, তা নইলে আমাদের আত্মহত্যা করতে হবে।
কেন? কী হয়েছে তোমাদের?
প্রবাল বললো, আমরা দুজনেই দারুণ অন্যায় করেছি।…
বাণী আর চেপে রাখতে পারল না। বললো, আমি প্রেগন্যান্ট।
মিঃ সোম চমকে উঠলেন, প্রেগন্যান্ট।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি প্রেগন্যান্ট। আপনাকে এখুনি আমাদের বিয়ে দিতে হবে।…
কিন্তু…
না, না, কোন কিন্তু শুনব না। আপনি বিয়ে না দিলে আজ রাত্রেই আমাদের…
চুপ করো, চুপ করো। ওসব কথা বলো না।
ওরা দুজনে আরো অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করল, আরো অনেকক্ষণ অনুনয়-বিনয় করল।
খুব জোরে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে মিঃ সোম বললেন, আমি শুনেছি কোন কোন ম্যারেজ অফিসার একটু বেশী টাকা পেলেই…
বাণী কঁদতে কাঁদতে হঠাৎ গলার মোটা হার খুলে ওর সামনে রেখে বললো, আপনি যা চান…
মিঃ সোম একটু হেসে বললেন, আমি বেআইনী কাজ করি না কিন্তু…
ওরা দুজনে প্রায় একসঙ্গে বললো, কিন্তু কী?
আমি চাই না, কোন শিশু কলংকের বোঝা মাথায় এই পৃথিবীতে আসুক!…
.
প্রবাল বললো, আপনার কাছ থেকে সার্টিফিকেট পাবার পরই আমরা কলকাতা থেকে সরে পড়লাম।
মিঃ সোম জিজ্ঞাসা করলেন, তখন কী তুমি বি. এ. পাস ছিলে?
বি-কম পার্ট টু পরীক্ষা দিয়েছিলাম। তবে জব্বলপুরে যাবার মাসখানেক পর খবর পেলাম, পাস করেছি।
বাণী বললো, আপনার আশীর্বাদে আমিও সেবার পাস করি।
খুব ভালো।
প্রবাল বললো, প্রথমে ছোট মামার ওখানেই উঠেছিলাম কিন্তু মাস দেড়েকের বেশী থাকতে পারলাম না; কটা মাস কিভাবে যে আমরা বেঁচেছিলাম, তা শুধু ভগবানই জানেন।
মিঃ সোম জিজ্ঞাসা করলেন, তারপর?
বাণী হেসে বললো, যে রাত্রে আমার ছেলে হলো তার পরদিনই ও সাড়ে চারশ টাকা মাইনের চাকরি পেল।
খুব ভাল।
প্রবাল একটু হেসে বললো, একদিন যে সন্তানকে অভিশাপ বলে মনে হয়েছিল, সেই ছেলের কল্যাণেই আমরা বেঁচে গেলাম। তাইতো আমরা ছেলের নাম রেখেছি সৌভাগ্য।