ফাদার, আমি পাস করেছি।
বৃদ্ধ ফাদার চেরিয়ান সঙ্গে সঙ্গে দুটো চোখ বন্ধ করে আপন মনে বললেন, ও লর্ড! তুমি সত্যি করুণার সাগর।
পরম পিতা যীশুকে ধন্যবাদ জানাবার কারণ আছে ফাদার চেরিয়ানের। পরমপিতার অপার করুণা না হলে পিতৃ-মাতৃহীন শিশুটিকে উনি কিছুতেই বাঁচাতে পারতেন না। সেদিনের সেই শিশুটি আজ বি. এ. পাস করল।
ভাবতে গিয়েই ফাদার চেরিয়ানের চোখে জল আসে। . আই এ্যাম রিয়েলি সস হ্যাঁপি মাই সন…
ছেলেটির চোখেও জল। সে কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, আমি তা জানি ফাদার।
ফাদার চেরিয়ানও নিজেকে সামলে নেন। ছেলেটির কাঁধে একটা হাত রেখে বললেন, মাই সন, গো ইনসাইড। প্রার্থনা করে এসো।
কয়েক দিন পরে ফাদার চেরিয়ান ওকে জিজ্ঞাসা করলেন, এবার কী করবে?
ভাবছি, চাকরি-বাকরি করব।
কোথায়?
আমাদের এই পালঘাটে কি আর চাকরি পাব; তাই ভাবছি, কোন বড় শহরে চলে যাব।
কোন্ বড় শহরের কথা ভাবছ? মাদ্রাজ না বোম্বে? নাকি কলকাতা?
মনে হয় বোম্বে যাওয়াই ভাল।
ইয়েস ইউ ক্যান গো দেয়ার। চেষ্টা করলে অত বড় শহরে নিশ্চয়ই কোন ভাল কাজ পেয়ে যাবে। তাছাড়া ঈশ্বরকে মনে রেখো; তিনি নিশ্চয়ই তোমাকে সব বিপদ থেকে রক্ষা করবেন।
.
মিঃ ম্যাথুজ একটু হেসে বললেন, বি. এ. পাস করার এক সপ্তাহের মধ্যেই আমি বোম্বে হাজির; আর বোম্বে আসার তিন দিনের মধ্যেই একটা চাকরিও জুটে গেল।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। তবে দুমাস পরেই ঐ চাকরি ছেড়ে দিলাম।…
কেন?
নেভির ষ্টোরে একটা চাকরি পেলাম।
কোথায় থাকতেন?
থাকতাম চেম্বুরের এক মেসে।
তারপর কি হলো বলুন।
দুবছর বোম্ব ছেড়ে কোথাও যাই নি। দুবছর পর হঠাৎ খবর পেলাম, ফাদার চেরিয়ান খুব অসুস্থ। তাই তাকে দেখার জন্য ছুটেগেলাম পালঘাট। মিঃ ম্যাথুজ খুব জোরে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, আমি পৌঁছবার পরদিন ভোরবেলায় ফাদার চেরিয়ান মারা গেলেন।
মারা গেলেন?
হ্যাঁ।
ওঁর কত বয়স হয়েছিল?
সেভেনটি ফোর। মিঃ ম্যাথুজ একটু থেমে বললেন, উনি আমার বাব-মা শিক্ষক ভাই-বন্ধু সবকিছু ছিলেন। তাই সাত দিনের ছুটি নিয়ে গেলেও পুরো একমাস পড়ে রইলাম ঐ পালঘাটে।
তারপর?
ফাদার চেরিয়ানের ছোটভাই ব্যাঙ্গালোরে থাকতেন। উনি আমাকে জোর করে ব্যাঙ্গালোর নিয়ে গেলেন এবং সেখানেও দুসপ্তাহ কাটিয়ে দিলাম।
তারপর বোম্বে ফিরলেন?
হ্যাঁ। মিঃ ম্যাথুজ একটু ম্লান হাসি হেসে বললেন, আমার ঐ দুঃখের দিনেই কমলার দেখা পেলাম।
কোথায়?
ট্রেনেই।
কী ভাবে আলাপ হলো?
ট্রেনে প্রায় সামনা-সামনি বসে থাকলেও আলাপ হয়নি। আলাপ হলো, দিন দুয়েক পরে চেম্বুর স্টেশনে।
.
দুজনেই দুজনকে দেখে অবাক। দুজনেই একটু হাসেন। তারপর ম্যাথুজই দুএক পা এগিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনি এখানে?
আমি তো এই চেম্বুরেই থাকি।
তাই নাকি?
হ্যাঁ।
আমিও তো চেম্বুরে থাকি।
সে কি?
সেদিন আর বিশেষ কথা হল না। ট্রেন আসতেই দুজন হারিয়ে যায়।
কদিন আবার এই চেম্বুর ষ্টেশনেই দেখা। আবার কিছু কথা। তারপর পর পর কদিন দেখা। আরো কিছু কথা কখনও কখনও একই ট্রেনে পাশাপাশি বসে যাতায়াত। মাঝে মাঝে দেখা হয় না।
এইভাবেই মাস ছয়েক কেটে গেল।
তারপর একদিন ম্যাথুজ কমলার অফিসে ফোন করল, ঠিক বুঝতে পারছি না আপনাকে একটা অনুরোধ করা উচিত হবে কিনা।
এত দ্বিধা করছেন কেন। কি বলতে চান বলে ফেলুন।
ম্যাথুজ তবু একটু দ্বিধা করে। আস্তে আস্তে বলে, এ সংসারে আমার কোন আপনজন নেই।…
কমলা বিশ্বাস করতে পারে না। বলে, তাই কখনো সম্ভব।
সত্যি আমার কোন আপনজন নেই।
আপনার বাবা-মা নেই।
না, ওরা আমার ছোটবেলায় মারা যান।
ভাইবোন।
না, আমার কোন ভাইবোনও নেই।
মামা-কাকারাও নেই।
থাকলেও আমি জানি না।
কমলা সঙ্গে সঙ্গে কোন কথা বলতে পারে না। একটু ভেবে জানতে চায়, আপনি কার কাছে থেকে লেখাপড়া করলেন।
আমাদের পালঘাটের ফাদার চেরিয়ানই আমাকে মানুষ করেছেন, লেখাপড়া শিখিয়েছেন।
তাহলে উনিই তো আপনার আপনজন।
উনিও মারা গেছেন। ম্যাথুজ একটু থেমে বলে, ওর মৃত্যুর পর যখন আমি ফিরছিলাম তখনই তে ট্রেনে আপনাকে প্রথম দেখি।
তাই নাকি।
হ্যাঁ।
কিন্তু আমাকে তো তা কোনদিন বলেন নি।
আমার দুঃখের কথা বলে অন্যের মন ভারাক্রান্ত করার ইচ্ছা আমার হয় না।
কমলা একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, সত্যি, আপনি অদ্ভুত মানুষ। এবার বলুন কি অনুরোধ করতে চান?
আগামী শুক্রবার আমার জন্মদিন। তাই ভাবছিলাম আপনি যদি সেদিন আমার সঙ্গে ডিনার খান, তাহলে…..
আপনার জন্মদিনে আপনি কেন খাওয়াবেন।
আমিই আপনাকে খাওয়াব।
না, না, আমিই…..
কেন? আমি খাওয়ালে কী আপনি খাবেন না।
না, না, তা বলছি না।…..
কাল অফিস ছুটির পর আপনি আমার অফিসে চলে আসবেন। তারপর একসঙ্গে বেরুব।
.
মিঃ ম্যাথুজ একটু ম্লান হাসি হেসে বললেন, জানেন মিঃ সোম, কমলা আমার জন্মদিনে কি করেছিল।
কী?
সেদিন সকালে একই ট্রেনে দুজনে বোম্বে এলাম। নিজেও অফিস গেল না, আমাকেও যেতে দিল না। দুজনে মিলে খুব ঘুরে বেড়ালাম, সিনেমা দেখলাম। তারপর ডিনার খেয়ে বেশ রাত্রে চেম্বুর ফিরে গেলাম।
মিঃ সোম শুধু একটু হাসেন।
আরো মজার কথা শুনবেন?
কী?
সেদিন কমলা আমাকে একটা পয়সা খরচ করতে দিল না। উপরন্তু আমাকে একটা শেফাস ফাউন্টেন পেন প্রেজেন্ট করেছিল।
মিঃ সোম এবারও কোন প্রশ্ন করেন না। শুধু ম্যাথুজ সাহেবের দিকে তাকিয়ে থাকেন।