তারপর?
মেমসাহেবের সঙ্গেও চোপড়া সাহেবের খুব দোস্তি।
তাই নাকি?
চোপড়া সাহেব মেমসাহেবের সঙ্গে দু-তিন ঘণ্টা গল্প করে যাবার সময় আমাকে জরুর বিশ-পঁচিশ রুপেয়া দিয়ে বলবেন কিসীকে মাত বোলনা, হাম আয়ীথী।
তুমি কাউকে বলো নাকি?
নেই বাবুজি, কাউকে বলি না।
তোমার মেমসাহেব তোমাকে টাকা দেন না?
সব সময় দেন না, তবে চোপড়া সাহেবের সঙ্গে পিকচার দেখতে গেলে আমাকেও পিকচার দেখার টাকা দেন।
তাহলে তুমি তো ভালই আছে।
সরলা হেসে বললো, বড়া আদমীর কোঠীতে নোকরি করে আরাম আছে।
তোমার নিশ্চয় অনেক টাকা জমেছে?
সরলা চোখ দুটো বড় বড় করে বলে, ঐ শালা হরভজন চুরি না করলে আমার অনেক টাকা……
হরভজন আবার কে?
সাহেবের ড্রাইভার। সাহেব না থাকলেই ঐ শালা হরভজন রাত্রে আমার ঘরে আসবে।…….
মিঃ সোম হেসে ফেলেন।
সরলাও হাসে। বলে, ও শালা আমাকে প্যারও করে, আমার টাকাও চুরি করে।
তুমি বিয়ে করবে না?
দো-এক সাল বাদ সাদি করব।
কাকে বিয়ে করবে?
বোধহয় হরভজনকেই সাদি করব।
সোম সাহেব একটু হেসে বললেন, কিন্তু হরভজন যে তোমার টাকা চুরি করে।
সরলা একটু সলজ্জ হাসি হেসে বললো, বাবুজি, আমার তো টাকার দরকার নেই, কিন্তু ওর টাকার জরুরত আছে।
কেন? হরভজন কী গুলসান সাহেবের কাছ থেকে মাইনে পায় না?
সরলা বেশ চিন্তিত হয়ে বললো, গাঁওতে ওর বিবি-বাচ্চারা আছে আর ওদের অসুখবিসুখ লেগেই আছে।
সোম সাহেব মনে মনে হাসলেও বেশ গম্ভীর হয়ে বললেন, তাই বুঝি ও তোমার টাকা নেয়?
হ্যাঁ, বাবুজি।
আচ্ছ৷ সরলা, হরভজন এমনি বেশ ভাল লোক, তাই না?
হ্যাঁ বাবুজি, হরভজন আচ্ছা আদমী আছে। এবার ও চোখ দুটো বড় বড় করে বললো, ওর মোটর চালান দেখলে আপনার দিলখুশ হয়ে যাবে।
আচ্ছা!
সরলা সহজ সরল আদিবাসী মেয়ে। মানুষকে সে বিশ্বাস করে, ভালবাসে। নগরজীবনের নোংরামী বা কুটিলতাকেও সে সহজভাবে গ্রহণ করে, মেনে নেয়। শুধু দুমুঠো অন্ন আর একটু আশ্রয়ে জন্য আজ কোথা থেকে সে কোথায় এসে পৌঁচেছে। তার সারল্যের সুযোগ নিচ্ছে প্রভু ভৃত্য সমানভাবে কিন্তু এরপর? যেদিন সরলার মধু ফুরিয়ে যাবে? যখন ওদের নেশা কেটে যাবে? তখন?
ভাবতে গিয়েও সোম সাহেবের মাথা ঘুরে যায়।
হঠাৎ সরলা বললো, বাবুজি!
কী?
এক রোজ হরভজনকে নিয়ে আসব?
নিশ্চয়ই।
সরলা আরো পাঁচ-দশ মিনিট গল্প করার পর চলে গেল।
মিঃ সোম নিজের মনে মনেই ভাবেন। না ভেবে পারেন না। আমাদের মধ্যে কত গুলসান আর চোপড়া লুকিয়ে রয়েছে, তা ভেবেই উনি চমকে ওঠেন।
সরলা বিয়ে না করলেও সমাজের যে ছবি তার কাছে প্রকাশ করল, তার জন্য তিনি মনে মনে ঐ মেয়েটিকে ধন্যবাদ না জানিয়ে পারেন না।
.
বাঘ-ভাল্লুক পশু-পক্ষীর মধ্যে ভালবাসার বিশেষ মরশুম আছে। মানুষের ভালবাসার, প্রেম করার কোন মরশুম নেই। তাইতো গ্রীষ্ম বর্ষা, শরৎ-হেমন্ত, শীত-বসন্তে মানুষের জন্ম হয়। এখন বিয়েও হয়।
ভাদ্র মাসের প্রথম দিনেই যিনি বিয়ের নোটিশ দিতে এলেন তিনিও এক সাহেব। পাত্রী প্রতিবেশীর আয়া। তবে ইনি গুলসান সাহেবের মত ছোঁকরাও নন, বিবাহিতও নন। এ সাহেব যৌবনের শুরুতে প্রেম করলেও বিবাহ করতে পারেন না বলে মনের দুঃখে সুদূর ত্রিবাঙ্কুর-কোচিন থেকে কলকাতা চলে আসেন।
এ অনেক কাল আগেকার কথা। তখন কলকাতায় ঘোড়ার ট্রাম না চললেও রাইটার্স বিল্ডিং আর লাট সাহেবের বাড়ীর মাথায় ইউনিয়ন জ্যাক উড়ত। এই ম্যাথুজ সাহেব কয়েক দিনের জন্য কোট্টায়ামের এক পরিচিতি ভদ্রলোকের ভবানীপুরের বাড়ীতে অতিথ্য গ্রহণ করলেন। সে পরিবারের আতিথ্য উপভোগের সম্মান বেশী দিন না পেলেও ঐ ভদ্রলোকের সুপারিশে একটা সত্যিকার সাহেবী কোম্পানীতে একটা চাকরি পেলেন।
বিলিভ মী, মিঃ সোম, আমি ওকে ঠিক আমার ফাদারের মত রেসপেক্ট করতাম। উনি আমাকে বাড়ীতে থাকতে না দিলেও আই এ্যাম ভেরী ভেরী গ্রেটফুল টু হিম।
মিঃ সোম বললেন, যিনি আপনাকে প্রথম আশ্রয় দেন, যিনি চাকরি দেন, তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকাই তো উচিত।
মিঃ সোম আমার বাসায় কার কার ফটো আছে জানেন?
কার কার?
নম্বার ওয়ান মাদার মেরী এ্যাণ্ড ফাদার জিসাস, নাম্বার টু আমার বাবা-মার এ্যাণ্ড নাম্বার থী এই ভদ্রলোকের।…….
মিঃ সোম অত্যন্ত খুশী হয়ে বললেন, ভেরী গুড। * মিঃ ম্যাথুজ আজ বিয়ে করতে এসে পুরানো দিনের স্মৃতি রোমন্থন না করে পারেন না। বলেন, বিলিভ মী মিঃ সোম, আমি কমলাকে সত্যি দারুণ ভালবাসতাম এ্যাণ্ড পসিবলি আই স্টিল লাভ হার। কিন্তু বিয়ের প্রস্তাব করায় কমলা এ্যাণ্ড হার আংকল আমাকে এমন অপমান করল যে রাগে, দুঃখে, অপমানে আই স্টার্টেড গোয়িং টু প্রসটিটিউট।…
আপনি বেশ্যা বাড়ী যেতেন?
ইয়েস মিঃ সোম। এবার একটু হেসে মিঃ ম্যাথুজ বললেন, ডোন্ট ফরগেট ব্যর্থ প্রেমিক প্রাণ দিতেও পারে, নিতেও পারে। সুতরাং বেশ্যাবাড়ী যাওয়া তো কিছুই না।
একটু চুপ করে থাকার পর মিঃ সোম জিজ্ঞাসা করলেন, কমলার সঙ্গে কোথায় আপনার ভাব হয়?
ম্যাথুজ সাহেব একটু হেসে বললেন, শুনবেন কমলার কথা?
মানুষের সুখ-দুঃখের কাহিনী শুনতে আমার ভালই লাগে।
ভেরী গুড! তাহলে শুনুন।
.
সে অনেক বছর আগেকার কথা।
ফাদার চেরিয়ান চার্চের সামনেই পায়চারী করতে করতে বাইরেল পড়ছিলেন। ছেলেটি দৌড়ে এসে ওর সামনে থমকে দাঁড়াতেই ফাদার চেরিয়ান একটু হেসে বললেন, ইয়েস মাই সন।