প্রবীর কথা বলেন না। সুমিত্রা বললেন, শুরুতে সত্যি খুব ইণ্টা রেস্টিং মনে হয়েছিল কিন্তু পরে তার জন্য দুজনকেই অনেক খেসারত দিতে হয়।
এবার প্রবীর বললেন, ফর্ম দেখেই বুঝতে পারছেন, সুমিত্রার বিয়ে হয়েছিল এবং…
মিঃ সোম বললেন, এখন আর ওসব পুরনো কথা মনে করে কী লাভ? যা হবার তা তো হয়েই গেছে, এখন…
সুমিত্রা বললেন, এমন দিনে যদি সব কথা মনে না পড়ে তাহলে আর কবে পড়বে? উনি একটু উত্তেজিত হয়ে বললেন, আমার বাবা অত্যন্ত বদমেজাজের লোক ছিলেন। আমার মায়ের কাছ থেকে উনি আমার মনের কথা জানতে পেরেই—
.
সুমিত্রা ঘরে ঢুকতেই ওর বাবা দরজা বন্ধ করে দিলেন। ড্রয়ার থেকে রিভলবার বের করে টেবিলের উপর রাখলেন। তারপর সোজা সুজি মেয়ের দিকে তাকিয়ে গিরীশবাবু বললেন, শুনে রাখো সুমি, আমার জীবিতকালে যদি তুমি নিজের খেয়ালখুশি মতো বিয়ে কর, তাহলে তোমার বিয়ের আসরে আমি আত্মহত্যা করব।
সুমিত্রা মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
গিরীশবাবু আবার বললেন, আমি জীবিত থাকতে আমাদের বংশে এসব কেচ্ছাকেলেঙ্কারি হতে পারবে না।
গিরীশবাবুর ঘর থেকে বেরিয়ে সুমিত্রা নিজের ঘরে যেতেই ওর মা ছুটে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, উনি কী বললেন?
রাগে, দুঃখে, ঘেন্নায় সুমিত্রা মুখ ঘুরিয়ে বললো, তুমি যে কী করে এই গুণ্ডা স্বামীকে এতকাল বরদাস্ত করলে, তা আমি ভেবে পাই না। এমন স্বামীর সঙ্গে আমার বিয়ে হলে হয় আমি তাকে মার্ডার করতাম, নয়তো আমি নিজে আত্মহত্যা করে মরতাম।
গিরীশবাবুর স্ত্রীর মুখ দিয়ে একটা শব্দ বেরোয় না।
সুমিত্রা বলে, আজ তোমাকে বলে রাখছি, বাবা জোর করে আমার বিয়ে দিলেও প্রবীরকে বিয়ে না করে আমি মরব না।
.
একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে মিঃ সোম জিজ্ঞাসা করলেন, তারপর কী হলো?
প্রচুর টাকা ব্যয় করে একটা অপদার্থের সঙ্গে বাবা আমার বিয়ে দিলেন।
তিনি কী করতেন?
সাদা প্যান্ট কালো কোট পরে কোর্টে যেতেন আর শ্বশুরের টাকায় রোজ বোতল বোতল মদ খেতেন।
মিঃ সোমের মুখ একটু বিকৃত হয়। মুখে কোন প্রশ্ন করেন না।
সুমিত্রা বললেন, অত মদ খাবার ফলে সিরোসিস অব লিভার হয়ে ভদ্রলোক তিন বছর পরই মারা গেলেন।
এবার প্রবীর বললেন, সতের বছর পরে হঠাৎ মাসখানেক আগে বর্ধমান স্টেশনে আমার সঙ্গে সুমিত্রার দেখা হলো।
বর্ধমান লোক্যাল ছাড়তে তখনও দেরী আছে। অপরাহুবেলার গাড়ি। যাত্রীর ভীড় নেই বললেই চলে। প্রবীরবাবু একটা ফাঁকা কম্পার্টমেন্টের জানলার ধারে বসলেন। এক ভড় চা খেলেন। তারপর একটু বিশ্রাম করবেন বলে পায়ের জুতো খুলে সামনের বেঞ্চিতে পা দুটো ছড়িয়ে দিলেন।
দুপাঁচ মিনিট কেটে গেল। তারপর হঠাৎ ছোটবেলার কথা মনে পড়ল প্রবীরবাবুর। মার কথা, বাবার কথা, ছোট ভাই সুবীরের কথা। প্রথম রেলগাড়ি চড়ে কাশী যাবার কথা।
জীবনের প্রথম রেলগাড়ি চড়ার আনন্দের কথা, উত্তেজনার কথা মনে করেই প্রবীরবাবুর একটু হাসি পায়।…
সুবীর দুহাত দিয়ে মার মুখখানা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলে, আচ্ছা মা, দাদা বলছে সাহেব না হলে রেলগাড়ি চালাতে দেয় না; সত্যি কী?
মা সুবীরের জামার বোতামগুলো ঠিক করে লাগাতে লাগাতে বললেন, বড় বড় গাড়ি সাহেবরাই চালায়।
আচ্ছা মা, দাদা বলছিল, যেসব সাহেবরা গাড়ি চালায় তারা বলে খুব মোটা আর রাগী হয়।
মা কোনমতে হাসি চেপে বলেন, বোধহয়।
আচ্ছা মা রেলগাড়ি জোরে চলে না কি জাহাজ?
রেলগাড়ি।
সুবীর দাদার গভীর জ্ঞানের প্রমাণ পেয়ে মুগ্ধ হয়। বলে, তাহলে দাদা ঠিকই বলেছে।
সুবীর ছোটবেলায় বড্ড বেশী বকবক করতো। মিনিটে মিনিটে প্রশ্ন করতে দাদাকে। হেরে যাবার ভয়ে আর বড় ভাইয়ের সম্মান বজায় রাখার লোভে প্রবীর ওর প্রতিটি প্রশ্নের জবাব দিত।
বর্ধমান লোক্যালের প্রায় ফাঁকা কম্পার্টমেন্টে বসে সেসব দিনের কথা ভাবতে বেশ লাগে প্রবীরবাবুর। খুশীর হাসি ছড়িয়ে পড়ে সারা মুখে। তারপর হঠাৎ সে খুশীর হাসি উবে যায়। মন বিষণ্ণ হয়। মার মৃত্যু, বাবার মৃত্যু, সুবীরের বিদেশ যাওয়া–সব যেন কেমন এলোমেলো হয়ে গেল।
তারপর?
তারপরের দিনগুলোর কথা ভাবতে গিয়েই সুমিত্রার কথা মনে পড়ে প্রবীরবাবুর।…
সুমিত্রা প্রবীরের একটা হাতের উপর নিজের হাতে রেখে বলে, দুঃখ করবে না। বাবা-মা কি চিরকাল থাকেন?
–না, তা থাকেন না কিন্তু…
সুমিত্রা একটু হেসে বলে, সূর্যমুখী বা পদ্মের মতো সব ফুল কি দীর্ঘজীবী হয়? হয় না। অনেকেই শিউলির মতো সাত সকালে ঝরে পড়ে কিন্তু তাই বলে কি শিউলির মাধুর্য বা সৌরভ কম?
সুমিত্রার কথায় প্রবীর মুগ্ধ হয়। বলে, সত্যি তুমি এত সুন্দর কথা বলে যে তোমাকে কাছে পেলে অনেক দুঃখই আমি ভুলে যাই।
–তোমার কাছে এলে আমিও আমার দুঃখ ভুলে যাই।
–জানো সুমিত্রা, আমার এম. এ. পড়ার একটুও ইচ্ছা ছিল না কিন্তু বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে ভর্তি হয়ে যাই। এখন মনে হয়, তোমার দেখা পাব বলেই ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিলাম।
–কি জন্য ভর্তি হয়েছ, তা জানতে চাই না। তবে তুমি ফাস্ট ক্লাস না পেলে আমার সর্বনাশ।
–কেন
–কেন আবার? সবাই বলবে, আমার পাল্লায় পড়ে তোমার পড়াশুনা হলো না।
প্রবীরবাবুর কামরায় আরো দু-চারজন যাত্রী উঠেছেন। ঘড়ির কাটা আরো একটু এগিয়েছে কিন্তু সেসব দিকে ওঁর খেয়াল নেই। উনি অতীত স্মৃতি রোমন্থন করতে বিভোর।…