মিঃ সোম নীতাকে দেখিয়ে অমূল্যবাবুকে জিজ্ঞাসা করলে এই রকমভাবে বিয়ে দিতে ওর বাবা-মা আপত্তি করলেন না?
মিঃ ঘোষাল বললেন, সামনের যোলই ওদের আনুষ্ঠানিক বিয়ে হবে। তবে আমরাও কণক নীতার বাবাকে স্পষ্ট বলেছি, এক হাজার টাকার এক পয়সা বেশী খরচ করতে পারবেন না।
মিঃ সোম একটু হেসে বললেন, মেয়ের বিয়ের কথা তো বাদই দিলাম। সমস্ত বাঙ্গালী জামাইষষ্ঠীতে যে টাকা ব্যয় করে, তা দিয়ে বোধহয় প্রত্যেক বছর একটা নতুন স্টীল প্ল্যান্ট বা একটা শহর তৈরী করা যায়।
ওরা দু-তিনজনে একসঙ্গে বললেন, ঠিক বলেছেন।
.
হঠাৎ মেয়েটি প্রণাম করতেই মিঃ সোম চমকে উঠলেন। তাকিয়ে দেখলেন, মেয়েটি বেশ ডাগর-ভোগর। বয়স বড়জোর ছাব্বিশ-সাতাশ। মিসমিসে কালো রং কিন্তু মুখশ্রী বেশ সুন্দর। পরনে ছাপা শাড়ী। কানে রূপোর দুল।
বাবুজি, আপনি সাদির লাইসেন দেন?
ওর বোঝার সুবিধের জন্য মিঃ সোম বললেন, হ্যাঁ, আমি বিয়ের লাইসেন্স দিই।
মেয়েটি বেশ ব্যাকুল হয়ে প্রশ্ন করল, বাবুজি, আমাকে সাদির লাইসেন দেবেন?
নিশ্চয়ই দেব। কিন্তু তুমি কাকে বিয়ে করবে?
আমার সাহেবকে।
কে তোমার সাহেব?
গুলসান সাহেব।
কোন্ গুলসান সাহেব?
যে গুলসান সাহেবের বাঁচীতে কারখানা আছে, এখানে দপ্তর আছে, বোম্বাইতে দপ্তর আছে…। মেয়েটি পুরো কথা শেষ না করে মিঃ সোমকে জিজ্ঞাসা করে, আপনি সাহেবকে চেনেন তো?
না, আমি চিনি না।
যে গুলসান সাহেব হাওয়াই জাহাজে ঘুরে বেড়ায়, কালো রংয়ের বিরাট মোটর আছে…
না আমি চিনতে পারছি না।
কিন্তু বাবুজি, অমোর সাহেবকে তত কলকাত্তার সবাই চেনে। সবাই সাহেবকে রোজ টেলিফুন করে।
মিঃ সোম এবার ওকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার নাম কী?
আমাকে সবাই সরলা বলে।
তোমার দেশ কোথায়?
রাঁচীর ওদিকে।
তোমার বাবা-মা ওখানেই থাকেন?
বাপ আবার সাদি করে কোথায় চলে গেছে। মা তো সিং সাহেবের বাড়ীতে ছিলেন। তারপর আর খবর পাইনি।
মেয়েটার ব্যাপার খুব স্বাভাবিক নয় সন্দেহ করে মিঃ সোম জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কী বরাবর গুলসান সাহেবের বাড়ীতে কাজ করছ?
না, না। আগে আমি আরো তিনটে সাহেবের বাংলোয় কাজ করেছি। তারপর গুলসান সাহেব মেমসাহেবকে সাদি করলে…
এইরকমই সন্দেহ করছিলেন মিঃ সোম। তাই বললেন, গুলসান সাহেবের মেমসাহেব কোথায়?
সরলা সরলভাবেই বললো, মেমসাহেবের তো আবার লেড়কা হয়েছে। তাই তো মেমসাহেব চার মাহিনা দিল্লী আছে।
গুলসান সাহেব তোমাকে সাদি করবেন?
সরলা হেসে বললো, সাহেব আমাকে খুব প্যার করে।
তাই নাকি?
সরলা গর্বের হাসি হেসে বললো, সত্যি বাবুজি সাহেব, আধাকে খুব প্যার করে। সাহেব শটাকা দিয়ে শাড়ী কিনে দিয়েছে। আমাকে খুব ভাল খানা খাওয়ায়, মোটর চড়ায়। তারপর মুহূর্তের জন্য একটু থেমে বললো, মেমসাহেব না থাকলে আমি ত সাহেবের ঘরে রাত্তিরে থাকি।
মিঃ সোম একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তাহলে তোত তোমার সাহেব তোমাকে খুব প্যার করেন।
সরলা মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ।
কিন্তু সাহেব তোমাকে সাদি করবেন তত?
জরুর করবে। আমার যে বাচ্চা হবে। সাহেবকে তো সাদি করতেই হবে।
তোমার বাচ্চা হবে?
সরলা খুশির হাসি হেসে বললো, হ্যাঁ বাবুজি।
মিঃ সোম চুপ করে মাথা নীচু করে বসে থাকেন। কিছুক্ষণ পরে জিজ্ঞাসা করেন, তোমার সাহেব কোথায়?
সাহেব হাওয়াই জাহাজে চড়ে বোম্বাই গেছে।
কবে ফিরবেন?
সাহেব কালই ফিরবেন।
ঠিক আছে। সাহেবকে নিয়ে এসো। আমি তোমার বিয়ের লাইসেন্স দিয়ে দেব।
আনন্দে খুশিতে হাসতে হাসতে সরলা বেরিয়ে গেল।
মিঃ সোম আপন মনে বললেন, তোমার সাহেবও আসছেন না,, আমাকে বিয়ের লাইসেন্সও দিতে হবে না।
সত্যি সরলা আর এলো না।
সরলার কথা প্রায় ভুলতেই বসেছিলেন, এমন সময় সরলা আবার হাজির।
কেমন আছো সরলা?
খুব ভাল আছি বাবুজি।
তোমার গুলসান সাহেবের খবর কী?
সাহেবও খুব ভাল আছেন?
তোমার বাচ্চা ভাল আছে?
আমার বাচ্চা হলো না বাবুজি।
কেন?
আমাকে সাহেব মস্ত বড় বিলাইতি পাস ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। ডাক্তার সাহেব আমাকে কত দাবাই দিলেন, সুই ফোঁটালেন, পেটে কত কি করলেন, কিন্তু বাচ্চা দেখতে পেলেন না।
মিঃ সোম না হেসে পারেন না। বলেন, তোমার সাহেব তত খুব ভাল মানুষ।
সাহেব তো আমার দেবতা আছে।
মেমসাহেব জানেন সাহেব তোমাকে প্যার করেন?
সাহেব আমাকে হর মাসে একশো টাকা দেয়। আমি তাই মেম সাহেবকে কিছু বলি না।
খুব ভাল করো।
যে সাহেব আমাকে এত প্যার করে, এত খুশী রাখে, এত টাকা দেয়, তার কথা আমি জরুর শুনব। বাবুজি, আমরা বেইমানি করি না।
মিঃ সোম একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলেন, না, না, সরলা, কারুর সঙ্গেই বেইমানি করা ভাল নয়।
নেই বাবুজি, আমি কারুর সঙ্গে বেইমানি করি না। সরলা একটু থেমে মিঃ সোমকে জিজ্ঞাসা করল, বাবুজি, আপনি চোপড়া সাহেবকে চেনেন?
কোন্ চোপড়া সাহেব?
বালীগঞ্জের চারতলা বাড়ীতে থাকে।…….
না, ঠিক চিনতে পারছি না।
এ চোপড়া সাহেবেরও কারখানা আছে, নিজে মোটর চালায়……
তুমি বুঝি ওকে চেনো?
খুব ভাল করে আমি চিনি।
হঠাৎ মিঃ সোমের মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, উনিও কী তোমাকে প্যার করেন?
সরলা সঙ্গে সঙ্গে জিভ কামড়ে বললো, নেই বাবুজি। এই চোপড়া সাহেব আমার সাহেবের দোস্ত আছেন। আমার সাহেব হাওয়াই জাহাজে চড়ে বাইরে গেলেও চোপড়া সাহেব জরুর আসবেন।