মিঃ সোম মুখ নীচু করে বললেন, আমার এখানেই ওদের বিয়ে হয়েছে।
শিখা আবার একটু হাসলেন। বললেন, জানি।
এবার মিঃ সোম মুখ তুলে শিখার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা, এরকম কেন হলো বলুন তো?
সত্যি শুনতে চান?
যদি আপনার আপত্তি না থাকে তো…
না, না, একটুও আপত্তি নেই। শিখা একটু থেমে বললো, আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, কণিকা সব ব্যাপারেই নিজেকে ইমপোজ করতে চায়?
হ্যাঁ, তা লক্ষ্য করেছি।
স্বামী-স্ত্রীর মাঝখানে যদি একটা মেয়ে এসে সব সময় নিজেকে ইম্পোজ করে এবং স্বামী তা মেনে নেয়, তাহলে কী সংসার করা যায়?
তা ঠিক।
শিখা একটা চাপা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললো, আপনি শুনে অবাক হবেন সুবোধ কি জামা-প্যান্ট পরবে, তাও কণিকা বলে দিত।
হঠাৎ সেই দোকানের স্মৃতি মনে পড়ল ওর। তবে মুখে কিছু বললেন না।
শিখা বলে যায়, প্রত্যেক দিন অফিসের পর কণিকা আমাদের সঙ্গে আমাদের বাড়ীতে আসত এবং সংসারের প্রতিটি ব্যাপারে আমাকে নিন্দা করত। আমি যা রান্না করব, তা ওর পছন্দ নয়; আমি যে বেডকভার কিনব, তা ওর পছন্দ নয়, আমি যে জামাকাপড় পরব, তাও ওর পছন্দ নয়।…
সুবোধবাবু কিছু বলতেন না?
কণিকার রুচির প্রতি, বুদ্ধির প্রতি ওর এমনই শ্রদ্ধা যে ও কখনই কোন ব্যাপারে প্রতিবাদ করত না।
আশ্চর্য ব্যাপার।
এতেই আশ্চর্য হচ্ছেন? শিখা একটু হেসে বললো, আপনি শুনলে অবাক হবেন, আমাদের স্বামী-স্ত্রীর একান্তই গোপনীয় ও প্রাইভেট ব্যাপারেও…
থাক, থাক, ওসব আর বলবেন না। মিঃ সোম একটু থেমে বললেন, আপনি ডিভোর্স করে ভালই করেছেন কিন্তু…। মিঃ সোম কথাটা শেষ করতে পারেন না। একটু দ্বিধা হয়।
শিখাই জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু কী?
একটু সঙ্কোচের সঙ্গে মিঃ সোম বললেন, আপনি এভাবে কতদিন। থাকবেন?
কেন? বেশ তত আছি।
হাজার হোক আপনার বয়স তত বেশী নয়, তার উপর কিছুদিন বিবাহিত জীবন কাটিয়েছেন।
তাতে কী হলো?
এখন বোধহয় আপনার পক্ষে বেশীদিন একলা থাকা সম্ভব নয়।
আমার তো এখন একলা থাকতে বরং ভালই লাগছে।
এবার মিঃ সোম জিজ্ঞাসা করেন, আচ্ছা, আপনারা তিনজনে কী এখনও একই সেকশনে কাজ করছেন?
শিখা একটু হেসে বললো, না। কণিকা চাকরি ছেড়ে দিয়েছে; আর সুবোধ অন্য সেকশনে চলে গেছে।
একটু চুপ করে থাকার পর শিখা আবার বলে, সুবোধকে বিয়ে করার পর কণিকার আর আমাদের অফিসে চাকরি করা সম্ভব নয়।
কেন?
শিখা একটু হেসে বলে, এম. এ. পাস করার পর চাকরি শুরু করি কিন্তু তবু মাঝে মাঝে মনে হতো, কোন কলেজে পড়াবার সুযোগ পেলেই ভাল হতো। তাই মাঝে মাঝেই আমার এক অধ্যাপিকার বাড়ীতে যেতাম। উনি অবশ্য সব সময় বলতেন, মফঃস্বল কলেজে চাকরি করার চাইতে যে চাকরি পেয়েছ, তা অনেক ভাল। তবু আমি মাঝে মাঝে ওঁর কাছে যেতাম।
তারপর?
কবছর আগে এক রবিবার সকালবেলায় ঐ শিবানীদির ওখানে যেতেই
আরে শিখা, এসো, এসো। তোমার কথাই ভাবছিলাম।
কেন শিবানী দি? কলকাতার কোন কলেজে…
শিখা, না। আমার জানাশুনা একটি মেয়ে বড়ই বিপদগ্রস্ত। তাহ ভাবছিলাম তুমি যদি চেষ্টা করে মেয়েটিকে তোমাদের অফিসে ঢোকাতে পারতে তাহলে খুব ভাল হতো।
সেও বুঝি আপনার ছাত্রী?
না, কণিকা আমার ছাত্রী না কিন্তু এক ছাত্রীর সঙ্গে এককালে আমার কাছে নিয়মিত আসা-যাওয়া করতো।
মেয়েটির নাম বুঝি কণিকা?
হ্যাঁ।
উনিও কি এম. এ পাস?
না; বি. এ.।
আমাদের ওখানে কোন ভ্যাকান্সী আছে কিনা জানি না, তবে আপনি যখন বলছেন তখন নিশ্চয়ই চেষ্টা করব।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, চেষ্টা করে। কণিকা চাকরি না পেলে সত্যি খুব বিপদে পড়বে। শিবানীদি খুব জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, বেচারা যেভাবে দিন কাটাচ্ছে সে আর বলার নয়।
শিখা একটু হেসে বললো, আমি স্বপ্নেও ভাবিনি আমার কথায় কণিকার চাকরি হবে; কিন্তু ডিরেক্টর সাহেবকে অনুরোধ করতেই উনি রাজী হয়ে গেলেন।
মিঃ সোম অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন, তাহলে আপনিই ওকে চাকরি দেন?
হ্যাঁ, তা বলতে পারেন।
সুবোধবার কতকাল আপনাদের অফিসে চাকরি করছেন?
আমার বছর দুই আগে থেকে ও কাজ করছে।
মিঃ সোম আপন মনে একটু হাসেন। কি যেন ভাবেন। কয়েক মিনিট কেউই কোন কথা বলেন না। তারপর শিখাই প্রথম কথা বলে, কী ভাবছেন এত গভীরভাবে?
আর কি ভাবব? আপনার কথাই ভাবছি।
এবার শিখা একটু হেসে প্রশ্ন করল, শুধু আমার কথাই ভাবছেন? কণিকার কথা ভাবছেন না?
নিশ্চয়ই ভাবছি।
কী ভাবছেন?
ভাবছি যে আপনার দ্বারা এত উপকৃত হয়েছে, সে কিভাবে আপনার সর্বনাশ করল।
শিখা আবার একটু হাসে। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, এসব কথা কোনদিন কাউকে বলিনি, কিন্তু আজ আপনাকে বলছি, শুধু চাকরি দিয়ে নয়, সে সময় আরো অনেক ভাবে কণিকাকে সাহায্য করেছিলাম। তাছাড়া কণিকাকে সত্যি আমি ভালবেসেছিলাম।
তা আমি প্রথম দিনই বুঝেছিলাম।
আরো কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে শিখা চলে গেল। যাবার আগে মিঃ সোম বললেন, এদিকে এলে নিশ্চয়ই আসবেন। খুব খুশী হবে।
হ্যাঁ, আসব।
সত্যি এদিকে কোন কাজকর্মে এলেই শিখা আসত। একটু গল্প গুজব করে চলে যেত। সব সময় একলা আসত না, মাঝে মাঝে অফিসের কেউ-না-কেউ সঙ্গে থাকতেন। মিস ঘোষ বা মিসেস ব্যানার্জি ছাড়াও অলকবার কখনও কখনও শিখার সঙ্গে আসতেন।
এইরকমই কাউকে সঙ্গে এনে শিখা একবার জানিয়ে গেল, বিয়ের মাসের মধ্যেই কণিকার মেয়ে হয়েছে। হাসপাতালে আছে, সময় হলে একবার দেখে আসবেন।