কণিকা কপট গাম্ভীর্য নিয়ে বললো, নিজের মুখে নিজের ব্যর্থতার কথা আর কত বলব?
মিঃ সোম হাসতে হাসতে প্রশ্ন করলেন, সুবোধবাবু আপনি এত উদাসীন ছিলেন?
কণিকা আর উৎসাহ না পেয়ে বললো, শেষপর্যন্ত বুঝলাম, না, আমার কোন চান্স নেই।……
মিঃ সোম হাসতে হাসতে প্রশ্ন করেন, তাই বুঝি আপনি ওদের বিয়ের ঘটকালি করলেন?
এতক্ষণ চুপ করে থাকার পর শিখা বললেন, এবার আমাকেই ওর বিয়ের ঘটকালি করতে হবে।
মিঃ সোম বললেন, সে বিয়েও যেন আমার এখানেই হয়।
শিখা বললেন, সে আর বলতে হবে না।
আরো বেশ কিছুক্ষণ হাসিঠাট্টা গল্পগুজবের পর কণিকা বললেন, ওদের রেজেস্ট্রি বিয়ে হলেও লগ্ন দেখেই বিয়ে হবে।
মিঃ সোম আশ্বাস দেন, তাতে আমার কোন আপত্তি নেই।
ওরা চলে গেলেও মিঃ সোম ওদের কথাই ভাবেন। তিনজনকেই ওর ভাল লেগেছে। যেমন হাসিখুশি প্রাণবন্ত, সেই রকম ভদ্র, সভ্য, মার্জিত। কারুর মধ্যেই যেন কোন গ্লানি নেই।
দিন পনের পরে শিখার ভাইকে সঙ্গে নিয়ে কণিকা এসে বলে গেল, সাতাশে শ্রাবণ বিয়ের দিন ঠিক হয়েছে। সাতটা বাহান্ন থেকে নটা আঠারোর মধ্যে বিয়ে হবে।
মিঃ সোম বললেন, ঠিক আছে।
আমরা আপনার সামনে সামান্য একটু অনুষ্ঠানও করব।
তাতেও আপত্তি নেই।
.
সাতাশে শ্রাবণ।
সাড়ে সাতটা বাজতে না বাজতেই কণিকার নেতৃত্বে পনের কুড়ি জনের এক পার্টি এসে হাজির। সুবোধবাবু বরের বেশে ও শিখা নববধূর সাজে এসেছে। সঙ্গে দুপক্ষের কিছু আত্মীয়স্বজন ছাড়াও অফিসের বন্ধুবান্ধবরা এসেছেন।
প্রথমে আইন অনুসারে বিয়ে হলো। তারপর সাত পাক ঘোরা, মালাবদল। এক ব্রাহ্মণ বৈদিক মন্ত্রও পাঠ করলেন। সবশেষে মিষ্টি মুখের ব্যবস্থা।
মিঃ সোমের এখানে ঠিক এ ধরনের বিয়ে হয়নি। তাই মাঝে মাঝেই এই বিয়ের স্মৃতি ওর মনে পড়ে।
তিন-চার মাস পরে মিঃ সোম আর তার স্ত্রী সাবিত্রী কিছু কেনাকাটা করতে বেরিয়ে সুবোধবাবু ও কণিকাকে দেখলেন। ওরা টের না পেলেও মিঃ সোম মুগ্ধ হয়ে ওদের দেখেন, ওদের কথা শোনেন।
সুবোধবার একটা জামার কাপড় হাতে তুলতেই কণিকা বললেন, না, না, এটা তোমাকে মানাবে না।
সুবোধবাবু বললেন, অফিসের কাকে যেন এই ধরনের জামা পরতে দেখে শিখার খুব পছন্দ হয়েছিল। ও বলছিল–
শিখার পছন্দের কথা বলো না।
সুবোধবাবু আর কথা বলেন না। কণিকা জামার কাপড় পছন্দ করে বললো, দর্জিকে ঠিকমত বুঝিয়ে বলল। আগের জামার মত হলেই কেলেঙ্কারী।
মিঃ সোম রাস্তাঘাটে কদাচিৎ কখনও সুবোধবাবু ও কণিকাকে একসঙ্গে দেখতেন কিন্তু তার কোন বিশেষ তাৎপর্য বুঝতে পারতেন না। বছরখানেক পরে হঠাৎ একদিন ওরা দুজনে মিঃ সোমের কাছে এসে বিয়ের নোটিশ দিতেই সব তাৎপর্য বোঝা গেল।
মিঃ সোমের মনে অনেক প্রশ্ন এলেও উনি কিছু জিজ্ঞাসা করলেন। উনি জানেন, এসব নিতান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। এসব ব্যাপারে তৃতীয় ব্যক্তির নাক গলানো মোটেই উচিত নয়। তবে সুবোধর নিজেই কোর্টের অর্ডার দেখিয়ে বললেন, জানেন মিঃ সোম, যা চকচক করে তা অধিকাংশ সময়েই সোনা হয় না।
মিঃ সোম একটু ম্লান হাসি হেসে বললেন, গুরুজনরা তত তাই বলেন।
এবার কণিকা বললো, শিখা মেয়েটা ভাল কিন্তু কিভাবে স্বামীকে সুখী করতে হয় তা জানে না।
মিঃ সোম বললেন, অনেক মেয়ে যেমন স্বামীকে সুখী করতে জানেন, সেইরকম অনেক স্বামীও জানেন না কিভাবে স্ত্রীকে সুখী করতে হয়।
কণিকা বললো, তা ঠিক।
এবার মিঃ সোম বললেন, আসল কথা, আমরা সবাই যদি একটু বিচার-বিবেচনা করে চলতাম তাহলে এই পৃথিবীটা আরো অনেক সুন্দর হতে পারতো।
ওরা চলে গেলেও মিঃ সোমের মনে কিছু প্রশ্ন, একটু বিস্বাদ থেকে গেল।
.
তারপর একদিন ওদের বিয়ে হলো। সাক্ষী হিসেবে যারা এসেছিলেন তারা সুবোধবাবুর সঙ্গে শিখার বিয়ের সময় আসেন নি। অনুষ্ঠান শেষ হতেই ওরা চলে গেলেন। সুবোধবার আর কণিকা কিছু সময় গল্পগুজব করলেন।
কোন ভূমিকা না করেই সুবোধবাবু বললেন, কোনদিন ভাবিনি বিয়ে করব কিন্তু এমনই কপাল যে
ওকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই কণিকা বললেন, জানেন মিঃ সোম, আমি সত্যি ভাবিনি আমি সুবোধকে বিয়ে করব।
মিঃ সোম একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, সবই অদৃষ্ট।
কণিকা আবার বললেন, শিখা সত্যি ভাল মেয়ে। ওর অনেক গুণ আছে, কিন্তু সত্যি সংসার করতে জানে না। বিয়ের পর সুবোধ যেভাবে অফিস যেতো, তা দেখলে আপনি অবাক হতেন।
শিখার নিন্দা শুনতে মিঃ সোমের একটুও উৎসাহ ছিল না। তাই উনি বললেন, আপনাদের এসব ব্যক্তিগত কথা আমাকে না বলাই ভাল। আমি চাই আপনারা সবাই সুখী থাকুন।
সুবোধবাবু বললেন, আপনি আমাদের তিনজনকেই চেনেন বলেই কণিকা এসব বলছে।
মিঃ সোম একটু হেসে বললেন, আপনাদের তিনজনকে চিনি বলেই তো এসব শুনতে মন চাইছে না।
আর বিশেষ কিছু না বলে একটু পরেই ওরা দুজনে চলে গেলেন।
দিন দশ-পনের পরে হঠাৎ শিখা এসে হাজির। মিঃ সোম অবাক হয়ে বললেন, আপনি।
শিখা একটু হেসে বললো, এই পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম তাই ভাবলাম দেখা করে যাই।
খুব ভাল করেছেন।
আপনি কেমন আছেন?
আমি একরকম আছি। আপনি কেমন আছেন, তাই বলুন।
শিখা একটু ম্লান হেসে বললো, আমি কেমন আছি, তা কী আপনি জানেন না?
হ্যাঁ মানে…
আপনি তো জানেন, আমাদের ডিভোর্স হয়েছে?
মিঃ সোম মাথা নাড়লেন।
কণিকার সঙ্গে সুবোধের বিয়ে হয়েছে, তা তো নিশ্চয়ই জানেন?