ওঁরা আমাকে যত বেশী দূরে সরিয়ে দিয়েছেন, জন আর আমি তত বেশী কাছাকাছি এসেছি। ওঁরা আমাকে যত বেশী অপমান করেছেন, জন আমাকে তত বেশী সম্মান দিয়েছে। ওঁদের যন্ত্রণার জ্বালাকে ভুলিয়ে দিয়েছে জনের ভালবাসা আর সমবেদনা।
আমার পিতৃদেব আমাকে শুধু স্নেহ-ভালবাসা থেকেই বঞ্চিত করেন নি; বঞ্চিত করেছেন শুভ বুদ্ধি থেকে। তিনি আমার জন্মদাতা হলেও তার চরিত্রের কোন গুণই আমি গ্রহণীয় মনে করি নি। শুধু তাই নয়। বাবাকে আমি শ্রদ্ধাও করি না, ভালবাসিও না।……
চিঠিখানা পড়তে পড়তে মিঃ সোম আনমনা হয়ে পড়েন। মনে পড়ে সেই দুটি দিনের কথা। অনেক ছেলেমেয়েরই বিয়ে হলো ওর সামনে কিন্তু এমন আত্মপ্রত্যয় নিয়ে আর কোন মেয়েকে বিয়ে করতে দেখেন নি। ওদের বিয়ে দেবার পর মিঃ সোম জনকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, বিবাহিত জীবন কিভাবে কাটাবার পরিকল্পনা করেছেন?
জন হেসে জবাব দেন, প্রতি অনেক ঐশ্বর্য দেখেছে। ওসবের প্রতি ওর কোন মোহ নেই। ও আমার স্ত্রী, আমার সন্তানের মা হতে চায়; ওর আর কোন দাবি বা আশা নেই।
মিঃ সোম প্রীতির দিকে তাকাতেই ও বললো, ভবিষ্যতে দেখবেন আমি কিভাবে স্বামী ও সন্তানদের সুখী করি।
মিঃ সোম বললেন, নিশ্চয়ই আপনারা সুখী হবেন। জন একটু হেসে বললো, প্রীতিকে সুখী করা খুবই সহজ।
সোম সাহেব প্রশ্ন করলেন, তাই নাকি?
হ্যাঁ ও তো কিছু চায় না, শুধু ভালবাসা চায়। জন একটু থেমে বললো, ঐ ভালবাসা ছাড়া আমারও তো আর কিছুই দেবার ক্ষমতা নেই।
সেদিন বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হবার পর সামান্য কিছুক্ষণের জন্য কথাবার্তা হয়েছিল। সব কথা মিঃ সোমের মনে নেই কিন্তু প্রীতির একটা কথা কোনদিন উনি ভুলবেন না। ও বলেছিল, মিঃ সোম, আজ এই বিয়ের দিনই আপনাকে একটা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। আমাদের সন্তানদের কতদূর লেখাপড়া হবে, বল পারব না; তাদের সম্মান প্রতিপত্তি-ঐশ্বর্য হবে কিনা তাও জানি না কিন্তু জোর করে বলতে পারি আমাদের সন্তানরা নিশ্চয়ই ভদ্র, সভ্য ও চরিত্রবান হবে।
প্রীতির আত্মপ্রত্যয়ের কথা ভাবতে গিয়েও মিঃ সোম বিস্মিত হন। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকেন। ভাবেন ওদের কথা। তারপর আবার ওর চিঠিখানা পড়তে শুরু করেন।
…এ সংসারে সব মেয়েরাই বাবা ও দাদাদের মধ্য দিয়েই পুরুষদের সম্পর্কে ধারণা গড়ে তোলে। এরপর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই সে ধারণার পরিবর্তন হয়। বাবার কথা তা আগেই লিখেছি। বাবার দৌলতে আমি যে সমাজে বিচরণ করার সুযোগ পেয়েছি এবং পুরুষদের সম্পর্কে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি, তাও বিশেষ সুখকর নয়। বাবার হুকুমে, আমার নতুন মা-র তাগিদে আমাকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও কোন কোন পার্টি বা আউটিংএ যেতেই হয়েছে। প্রতিবারই অত্যন্ত তিক্ত অভিজ্ঞতা, নিয়ে ফিরে এসেছি এবং যে সমাজে আমি জন্মেছি, তার প্রতি আমার ঘৃণা আরো তীব্র হয়েছে। এই ঐশ্বর্যসম্পন্ন মানুষরূপী পশুগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্যও আমি জনকে বিয়ে করছি।…
প্রীতির এই দীর্ঘ চিঠির উত্তরে মিঃ সোম সামান্য কয়েক লাইনের চিঠি লিখেছিলেন। দিন দশেকের মধ্যেই আবার প্রীতির চিঠি এসেছিল। এই চিঠির শেষে সে লিখেছিল, জনকে বিয়ে করে আমি যে ভুল করিনি, তা প্রতি পদক্ষেপে বুঝতে পারছি। এ সংসারে মানুষ যে কত মহৎ হতে পারে, তা জনকে বিয়ে না করলে জানতে পারতাম না। কিন্তু এমন স্বামীর প্রতিও আমি আমার কর্তব্য পালন করতে পারছি না। তাই ঠিক করেছি, আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই আমরা এ দেশ ছেড়ে চলে যাব।…
ওদের কথা ভাবতে গিয়ে মিঃ সোমের দুটি চোখ ঝাঁপসা হয়ে ওঠে। হঠাৎ কলিং বেল বাজতেই তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে পড়েন।
বিয়ের নোটিশ দেবার ফর্মে সুবোধবাৰু আর শিখা সই করতেই কণিকা বললো, যাক, প্রথম পর্ব শেষ হলো। এবার তোমাদের বিয়ে দিয়ে হনিমুনে পাঠাবার পর আমার ছুটি।
মিঃ সোম হাসতে হাসতে বললেন, মনে হচ্ছে, আপনিই ঘটকালি করে এ বিয়ে দিচ্ছেন।
কণিকা হাসতে হাসতে বললো, তাহলে শুনুন। আমরা তিনজনেই এক অফিসের এক সেকশনে কাজ করি।শিখা আমার সবচাইতে ক্লোজ ফ্রেণ্ড। আস্তে আস্তে আমাদের দুজনের সঙ্গেই সুবোধের বেশ ভাব হয়। কণিকা এবার মুহূর্তের জন্য ওদের দুজনকে দেখে নিয়ে বললো, প্রথম প্রথম ভাবতাম, ও বোধহয় আমাকেই ভালবাসে……
ওর কথায় তিনজনেই হাসেন। :
ওদের হাসি দেখে কণিকা আরো সিরিয়াস হয়ে মিঃ সোমকে বললো, সত্যি বলছি, আগে আমার তাই ধারণা ছিল এবং সেজন্যই সিনেমা দেখার সময় সুবোধের হাতের উপর আমি হাত রাখতাম।…
কণিকার কথায় ওরা তিনজনে আরো জোরে হেসে ওঠেন।
কণিকা ওদের হাসি গ্রাহও করে না। বলে, অফিসের ক্যান্টিনে, রাস্তাঘাটে বা আউট্রাম ঘাটের ধারে ঘুরেফিরে বেড়াবার সময় কতবার সুবোধকে গদগদ হয়ে কত কথা বলেছি, কিন্তু সেসব ও আমলই দেয় নি।
মিঃ সোম গম্ভীর হয়ে বলেন, তাই নাকি?
কণিকা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলে, আমার দুখের কথা শুনলে আপনার চোখে জল আসবে।…
বলেন কী?
সুবোধের দিকে তাকিয়ে কত মুচকি হেসেছি, কত সময় ইসারায় কত কি বলেছি কিন্তু ও এমন ন্যাকামি করত যেন আমাকে চেনেই না।
শিখা মুখ টিপে হাসতে হাসতে বললো, তুই প্রেমপত্র লিখেও জবাব পাস নি, সে কথা বলবি না?