জন আমার ঘরের দরজার ওপাশ থেকে বললো, ছোটা মেমসাব, পড়তে বসবে না?
না। ভাল লাগছে না।
শরীর খারাপ লাগছে?
না; শরীর ভালই আছে।
তাহলে ছোটা মেমসাব পড়তে বসো। জন একটু থেমে বলে,
তোমাকে পড়তে দেখলে আমার খুব ভাল লাগে।
আমি এতক্ষণ জনের দিকে ফিরেও তাকাই নি, কিন্তু একথা শোনার পর ওর দিকে না তাকিয়ে পারলাম না। আমি কিছু বলার আগেই ও বললো, ছোটা মেমসাব, আমি সব বুঝতে পারি। তুমি লেখাপড়া করে বড় হলে সব দুঃখ ঘুচে যাবে।
আমি মুখ নীচু করে হাসি।
না, না, ছোটা মেমসাব, হাসির কথা নয়। যে মানুষ মন-প্রাণ দিয়ে লেখাপড়া করতে পারে, তাকে কোন দুঃখই ছুতে পারে না।
আমি জিজ্ঞাসা করি, তুমি কি করে জানলে?
জন সঙ্গে সঙ্গে দেশপাণ্ডে সাহেবের গল্প শুরু করে, লোকটা যেন বিদ্যের জাহাজ ছিল। ঘরভর্তি শুধু বই আর বই। কলেজে যাবার আগে, কলেজ থেকে ফিরে এসে সব সময় শুধু পড়তেন আর লিখতেন। কী বলব ছোটা মেমসাব, প্রফেসার সাহেব শুধু পড়াশুনা ছাড়া আর কিছুই জানতেন না।
তারপর?
প্রফেসার সাহেবের ছেলে আর পুত্রবধূ বিলেতে থাকত।…বোম্বতে প্রফেসার সাহেব আর তার ওয়াইফ থাকতেন। তারপর হঠাৎ ওঁর স্ত্রী মারা গেলেন। আমি ভাবলাম, লোকটা বোধহয় এবার সন্ন্যাসী হয়ে যাবে; কিন্তু না, দুএকদিন পর থেকে প্রফেসার সাহেব আবার পড়াশুনা শুরু করে সব দুঃখ ভুলে গেলেন।
জন এবার আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলে, ছোটা মেমসাব, তুমি লেখাপড়া করো। দেখবে তোমার মনেও কোন দুঃখ নেই।
আপনি বিশ্বাস করুন, এই জনের জন্যই আমাকে লেখাপড়া করতে হয়। ও না থাকলে কিছুতেই আমার লেখাপড়া হতো না; আমি কোনদিনই বি.এ.-এম.এ. পাস করতাম না।
কী হলো ছোটা মেমসাব? এখনই শোবে নাকি?
হ্যাঁ।
এখন তো মোটে সাড়ে নটা বাজে।
আমার বড় ঘুম পাচ্ছে।
পরীক্ষার আগে এত তাড়াতাড়ি ঘুম পেলে চলবে কেন? আমি তোমার জন্য এক কাপ ব্ল্যাক কফি আনছি। খাও; দেখবে ঘুম চলে গেছে।
জন কফি আনে। আমি কফি খাই। ও বলে, প্রত্যেক ঘণ্টায় ঘণ্টায় আমি তোমাকে কফি দেব। তুমি পড়ে যাও।।
ফাস্ট ডিভিশনে হায়ার সেকেণ্ডারী পরীক্ষা পাস করার পর বাবা আমাকে তিন দিনের জন্য সিমলা নিয়ে গেলেন। আমার নতুন মা আমাকে একদিন বড় হোটেলে ডিনার খাওয়ালেন। আর জন? ও আমাকে একখানা বাইরেল আর একটা শেফার্স কলম দিয়ে বলেছিল, ছোটা মেমসাব, আমি ক্রিশ্চিয়ান। অন্য ধর্মের কথা জানি না। তবে বাইরেলটা পড়ে দেখো, মনে শান্তি পাবে।
কিন্তু কলমটা দেবার কি দরকার ছিল?
জন হেসে বললো, আমি তো মহা পণ্ডিত। ভেবেই পেলাম না কোন বই তোমার ভাল লাগবে। তাই মনে হলো, কলম দেওয়াই সব চাইতে ভাল।
আমি অবাক হয়ে ওকে দেখি।
ও একটু আনমনা হয়। তারপর বলে, ছোটা মেমসাব, আমি নিশ্চয়ই তোমাদের এখানে চিরকাল চাকরি করব না। তখন এই কলম দিয়ে লিখতে গেলেই তোমার মনে পড়বে, জন চেয়েছিল তুমি অনেক লেখাপড়া শিখে বড় হও।
জনের কথা লিখতে গেলে অনেক কিছু মনে পড়ে। আমরা তখন কলকাতায়। আমি ব্ৰেবোর্নে পড়ি। বাবা অফিসের কাজে কয়েক দিনের জন্য গৌহাটি-শিলং-ইম্ফল ঘুরতে গেছেন। নতুন মা-ও তার সঙ্গিনী হয়েছেন। বাবা নতুন মা যেদিন রওনা হলেন, সেদিন রাত্রে শুতে যাবার আগে জন আমাকে বললো, ছোটা মেমসাব, তুমি দরজাটা ভিতর থেকে লক করে দিও।
কেন?
কেন আবার? আজ তো সাহেব-মেমসাহেব নেই, তাই……
তুমি তো আছে।
হাজার হোক আমি অশিক্ষিত খানসামা। আমার মাথায় কখন বদ বুদ্ধি চাপবে, তা কি কেউ বলতে পারে?
আমি হেসে বললাম, যে আমাকে বাইরেল উপহার দিয়েছে, সে কোনদিনই আমার ক্ষতি করবে না।
তুমি সত্যি তাই মনে কর?
আমি হাসতে হাসতে বললাম, আমি জানি তুমি আমাকে এত ভালবাসো যে তুমি আমার ঘরে শুলেও আমার কোন ক্ষতি করবে না।
আমার কথা শেষ হতে না হতেই জন আমার দুটো হাত চেপে ধরে বললো, ঠিক বলেছ ছোটা মেমসাব, আমি সত্যি তোমাকে খুব ভালবাসি। আমার দ্বারা তোমার কোন ক্ষতি হবে না।
তা আমি জানি। এবার আমি ওর আত্মতৃপ্তিভরা উজ্জ্বল মুখখানার দিকে তাকিয়ে বললাম, আমার একটা অনুরোধ রাখবে?
নিশ্চয়ই রাখব।
আজ থেকে তুমি আর আমাকে ছোটা মেমসাব বলবে না; তুমি আমাকে প্রতি বলেই ডাকবে।
কি বলছ তুমি?
হ্যাঁ জন, ঠিকই বলছি।
বাট…
কোন কিন্তু নয়; আগে কথা দাও।
জন একটু ভেবে বললো, ঠিক আছে, তোমাকে প্রীতি বলেই ডাকব, কিন্তু সাহেব বা মেমসাহেবের সামনে নয়।
জানেন মিঃ সোম, সেই রাত্রি থেকে আমার আর জনের মধ্যে বন্ধুত্বের নতুন অধ্যায় শুরু হলো।
আচ্ছ। জন, তুমি বিয়ে করনি কেন?
আমাকে তো দেখতে ভাল নয়। কোন মেয়ে আমাকে ভালবাসবে?
শুধু চেহারাটাই কি সব?
আমার বাইরের চেহারার মত ভিতরের চেহারাটাও যে আগলি নয়, তা কে বলতে পারে?
ডোন্ট সে দ্যাট : তোমার মত মানুষ কটা পাওয়া যায়?
সত্যি বলছি মিঃ সোম, ঈশ্বরের নামে শপথ করে বলছি, আমি আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম, আমার নতুন মা আমাকে ঈর্ষা করেন। উনি আমাকে যত বেশী ঈর্ষা করতেন, বাবাও তত বেশী উপেক্ষা করতে শুরু করলেন। দিনের পর দিন ওরা দুজনের কেউই আমার সঙ্গে কথা বলার সময় পেতেন না। একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া বা ঘোরাঘুরি একেবারেই বন্ধ হয়ে গেল। ভাবতে পারেন আমার মানসিক অবস্থা? আমার জ্বালা। আমার অব্যক্ত বেদনা।